Heading
আপডেট: ১৮ Jun ২০২৩, ১৬:০১
চৌধুরী পরিবারের ছেলেরা সবাই বিলেতে লেখাপড়া করেছে। সে ধারাতেই আমির চৌধুরীও তার একমাত্র ছেলে অমরকেও হায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিলেত পাঠিয়ে দেন।
সেখানে ওর চাচা অর্থাৎ আমির চৌধুরীর ছোট ভাই আমান চৌধুরীর সাথে তার বাড়ীতে থাকতো।
প্রথমে চাচার সাথে থেকে ওখানকার জীবন শুরূ করলেও পরবর্তীতে হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে অমর চৌধুরী।
বিশাল হোষ্টেল বিল্ডিং কমপ্লেক্স ওদের। আয়তকার চারতলা বিল্ডিং, মাঝখানটাতে একটা ফুটবল ফিল্ডের মত জায়গা। পুরনো কোন লর্ডের বাড়ী ছিল সেটা।
বিলেতের নিয়মানুযায়ী বাইরের আবরনটা অপরিবর্তিত রাখাতে পুরনো আদলের মনে হলেও ভিতরটা আধুনিক।
অমরের হোষ্টেলটা অন্যান্য পাশের মত মাঝখান দিয়ে চওড়া সিড়ি। সিড়ির ডান পাশে ছেলে আর বা পাশে মেয়েদের বসবাসের জায়গা। সিড়ি দিয়ে উঠতেই প্রতি তলায় রূমের সামনে লম্বা বারান্দা আর তারই শেষ প্রান্তে বাথরূম। সবগুলো তলা একই রকম।
ওই হোষ্টেলে বসবাসরত ওরই ক্লাসের একজন শেতাঙ্গ মেয়ের সাথে অমরের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চেরী ওর নাম। ভারী সুন্দরী মেয়েটা, চটপটে আর বন্ধুভাবাপন্ন।
প্রথম থেকেই একে অপরের ব্যপারে আগ্রাহান্নিত হয়ে ওঠে ওরা।
চেরী ষ্কটিস, বাবা মা নিজেদের খামারে কাজ করে। ওর বাবা ওখানকার স্থানীয় জননেতা। বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকেন।
এ লেভেল পাশ করার পর অমর আর চেরী একে অপরের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে শহরের একটা ফ্লাটে একত্রে বসবাস করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। বিলেতে সামর্থ্য ছেলেমেয়েদের একত্রে বসবাস করা সমাজের চোখে কোন দোষের ব্যপার নয়।
ক্লাস শেষে বিকাল পাচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত দুজনেই কাজ করে বড় একটা শপিং মলে। তারপর বাইরে ডিনার সেরে রাতে বাসায় ফেরে।
মাঝে মধ্যে ইউক এন্ডে ষ্কটল্যান্ডে ওর বাড়ীতে যায় চেরী। একবার অমরও গেল ওর সাথে।
অপূর্ব লাগলো ষ্কটিস গ্রাম। ছবির মত, শান্ত আর অপরূপ ওখানকার প্রকৃতি। কোন দূষন নেই আর নেই তেমন কোন জাতিগত মিশ্রনও।
লন্ডন শহরের অনেক অঞ্চলে রাস্তায় চলাচলরত নানা রঙের মানুষদের দেখলে মাঝে মধ্যেই ওটাকে বিলেত শহর বলে যেন চেনা যায় না। কিন্তু ওদের গ্রামগুলোতে নির্ভেজাল বসবাস ওদের জাতিগেষ্ঠির মানুষের।
দুদিন ছিল ওদের খামার বাড়ীতে। মানুষ খুবই পর্যটক বন্ধুভাবাপন্ন। ভীনদেশী চেহারায় ওকে দেখে সবাই স্বাগত জানালো।
গ্রামের মানুষগুলো রক্ষনশীল। ওরা নিজেদের মত থাকতেই পছন্দ করে। প্রকৃত পক্ষে একটা জনগোষ্ঠির ঐতিহ্য ধরে রাখে ওই গোষ্ঠির রমণীকূল আর গ্রামের মানুষ। তারই এক জলন্ত উদাহরণ এটা। নির্ভেজাল জনগোষ্ঠি এরা।
ফিরে আসার দিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চেরীকে ডাকলো ওর বাবা। কথা শেষ করে অনেক রাতে পাশের রূমে শুতে গেল চেরী।
বাবা মেয়ে কি নিয়ে এতক্ষন ধরে কথা বললো তা জানেনা অমর। তবে পরদিন ফেরত আসার সময় ট্রেনের ভিতর সারাক্ষন চেরী অন্যমনষ্ক হয়েই থাকলো।
ফেরত এসে চেরীর বেশ কিছুদিন লাগলো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে।
ওদের বাড়ী থেকে ঘুরে আসার পর চেরী অমরের বাড়ী, দেশ, মা বাবা সন্মদ্ধে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলো।
অমর ওদের বাড়ীর বিভিন্ন ছবি ওকে দেখালো। সবার সম্পর্কে বললো। যে কথাগুলো এত বছর ধরে ওকে বলার প্রয়োজন হয়নি। যে প্রসঙ্গগুলো ওদের আলোচনার কথাগুলোর কাছে অযাচিত ছিল এতদিন পর সেগুলো নিয়েও আলোচনা হল।
চেরী খুব খুশী হলো সব দেখে এবং শুনে।
-যাবে তুমি আমাদের ওখানে?
ওকে জিজ্ঞেস করলো অমর।
চেরী একটু হাসলো মুখ টিপে।
সেবার গরমের ছুটিতে ওরা দুজন মিলে প্যারিস, ভেনিস আর জুরিখে বেড়ালো প্রায় পনেরো দিন ধরে।
প্যারিস টাউয়ারের উচ্চতা আর ভেনিসের নৌকা ভ্রমনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় দুজনই হারিয়ে গেল মাঝে মাঝে। ইউরোপের রাস্তায় ট্রেনে ট্যাক্সিতে ব্যহ্যিক বৈশাদৃশ্য অন্তরঙ্গ দুটো মানুষকে দেখে অনেকে অযথা তাকালোও ওদের দিকে।
বিষয়টা ওদের দৃষ্টিগোচর হলেও আনন্দের আতিশয্যে কোন কিছুই ওদের আনন্দ আর উপভোগে ছেদ ফেলতে পারলো না।
অবশেষে গেল ইউরোপের সর্ববৃহত জলপ্রবাত রাঈন ফলস দেখতে। তিন দিন ছিল ওরা সেখানে।
প্রকৃতির মহামিলনের মহাসমারোহ যেন। পাহাড় পর্বত পেরিয়ে সব জঞ্জাল ঠেলে ফেলে রাঈন অবলা আক্রোশে আছড়ে পড়ছে কালো পাথরের বুকে। তার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে জলের ধোয়া আর তাতে সুর্য্য কিরণ আটকে এক অপরূপ সুরমুর্ছনার সৃষ্টি করছে।
উন্মাদনায় আত্মহারা রাঈন পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ে মূল ধারায় মিশে মহামিলনে স্বর্গীয় তৃপ্তিতে এগিয়ে চলেছে সমুদ্র দর্শনে।
প্রকৃতির এই মহামিলনের মহোৎসবের কাছে মানুষের ব্যহ্যিক সব ভেদাভেদ যেন কর্পূরের মত বিলীন হয়ে যায়।
অমর আর চেরী ওদের ভিতরকার বিধাতা প্রদত্ত দৈহিক আর সমাজ প্রদত্ত মানসিক যে আবরন টুকু এতকাল ওদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো রাঈনের আছড়ে পড়া জলের আঘাতে তা খন্ড বিখন্ড হয়ে ওরা একাকার হয়ে গেল দুজনে। রাঈনের ছোট্ট শহর ওদেরকে প্রকৃতির মত অভিন্ন করে রাখলো ঐ কয়েকটা দিন।
ফিরে এলো ওরা লন্ডনে। ঠিক করলো বিয়ে করবে। কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। আবার সামাজিক বিধি বাধ সাদলো।
কোন রীতি অনুযায়ী হবে বিয়েটা? চেরীর সমাজের রীতি না অমরের সমাজের রীতি অনুযায়ী!
অমর বললো ওরা চেরীর বাবাকে সব বলে একটা সমাধান করবে। কিন্তু ওর বাবার প্রসঙ্গটা আসাতে চেরী নিশ্চুপ হয়ে রইলো। নতুন করে মনে পড়লো ওর বাবার নিষ্ঠুরতা পূর্ণ বাস্তব উপদেশ গুলো।
-না, বাবার কাছে কিছুতেই যাওয়া যাবে না।
চেরীর কথায় অমরের বুঝতে বাকি রইলো না সে রাতে চেরীর বাবা অত রাত অব্দি কি সব কথা বলেছিলো ওর মেয়েকে।
নিজের বাবার সাবধান বাণী গুলোও সে মুহূর্তে অমরের কানে বাজতে লাগলো।
-বাবা তোমাকে পাঠিয়েছি লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার জন্য। নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য নয়। ভিন্ন জাতিগোষ্ঠিতে বিয়ে করলে মানুষ গোড়া সমেতই হারিয়ে যায়। সব সময় মনে রেখ তোমাকেই হাল ধরতে হবে। আরো মনে রেখ তোমার পরবর্তি সন্তানই তোমার পরে জমিদারী চালাবে। এখানকার মানুষ খুবই রক্ষনশীল ওরা কখনোই বৈষাদৃশ্য কাউকেই জমিদার হিসাবে মেনে নেবে না।
বাবার কথাগুলো অমরের কানে বাজতে লাগলো।
ওরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো।
ট্যুর থেকে ফিরে চেরীর কিছুটা শারিরীক অসুস্ততার জন্য ওরা ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার জানালো চেরী সন্তান সম্ভবা।
পৃথিবীর বাস্তবতার কঠোরতায় অপরিপক্ক দুটি জীবন যেন সিদ্ধান্তহীনতার গহীন সাগরে তলিয়ে যাচ্ছিলো। টেনে ধরলো অমরের চাচাতো ভাই জন। ও একজন ডাক্তার, বয়সে জনের থেকে প্রায় দশ বছরের বড়।
ও অভয় দিল সন্তান না হওয়া বা হওয়ার ব্যপারে ওরা তার উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারে।
তবে সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি নিতে হবে ওদের।
চেরীর দিকে তাকালো অমর।
ওরা জন’কে পরে জানাবে বলে বেরিয়ে আসলো।
দুজনে অনেকক্ষন ধরে বসে রইলো টেমসের পাড়ে।
কোন সিদ্ধান্তেই পৌছাতে পারলো না। জীবন সত্যি সত্যিই থমকে দাড়ালো ওদের সামনে।
এমনি সময় বাবার অসুস্ততার খবর এল। বাবা ওকে সব ফেলে ফিরে যেতে বলেছে। তার সময় নাকি ফুরিয়ে এসেছে।
একবার ভেবেছিল পালিয়ে থাকবে। পালিয়ে যাবে সব বাস্তবতা থেকে। কিন্তু ওর এ দুঃসময়ে প্রকৃত বন্ধুর মত চেরী ওর পাশে দাড়ালো।
-তুমি যাও বাবার কাছে। আমাদের সন্তান নিয়ে কোন চিন্তা করোনা। বাবা ছাড়া এদেশে ওকে বড় করে তুলতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না আমাকে। তুমি সব সামলে সুযোগ মত খোজ নিলেই হবে।
কথাগুলো বলে চেরী ওকে অভয় দিলো।