জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২।

আপডেট: 2022-09-25 13:09:06

অম্বরাবনী-২ 

 

অবনীর শরীরটা ভাল না, ওকে ভাল কোন ডাক্তার দেখানো দরকার এ কথাটা অবনীর মা কখনোই ওর বাবাকে বুঝাতে পারতেন না। বাবার যুক্তি –ছেলেটা খাওয়া দাওয়া কম করে, দেখতে ছিপছিপে এই তো এছাড়া ও তো নিজে কখনো কাউকে ওর শারীরিক কোন অসুবিধার কথা বলে না।
বস্তুত অতগুলো সন্তানের মধ্যে একজন খাওয়া দাওয়া কম করে এই নগন্য ব্যপারটাকে একটা সমস্যা বিবেচনা করে শত সমস্যার তালিকা আর বাড়ানোর মত সৌখিনতা করার মানষিকতা বা সংগতি কোনটায় বাবার ছিল না।
কিন্তু মায়ের মন কি এত সহজে তা মেনে নেয়। তিনি ওর চিকিৎসার জন্য অবনীর নানা বাড়ীর কাছে এক বৃদ্ধ কবিরাজ আছে তাকে দেখানোর মনস্ত করলেন।
রোকেয়া বেগম আসল উদ্দেশ্যের কথা কাউকে না বলে নিজের বাবার বাড়ী বেড়াতে যাওয়ার কথা জানিয়ে অবনীকে সাথে নিলেন। বাসে করে ঘণ্টা দুয়েকের পথ তারপর পায়ে হেটে আরো এক ঘণ্টার রাস্তা।
বাস থেকে নেমে মা আর ছেলে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে দুপাশে সবুজ ক্ষেতের বুকচিরে আঁকাবাকা মেঠো পথ ধরে হাটতে লাগলো।
অনেকদিন পর বাবার বাড়ী বেড়ানো। কত বাল্য সুখস্মৃতি মনের কোণে উঁকি ঝুকি দিতে লাগলো রোকেয়া বেগমের। তারপর অবনীর শরীরটা নিয়ে কবিরাজ দাদার সাথে কথা বলা। সব মিলে পুরোটাই সুখসপ্নের মত মনে হতে লাগলো রোকেয়া বেগমের কাছে।
অনেকদিন পর অবনীও যেন মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখা মেলেছে এই চির সবুজের দেশে। বড় ভাই বোনদের কড়া শাষন মুক্ত হয়ে অবনীও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এখানে আর কেউ নেই ওর মা ছাড়া।
প্রাণ খুলে কথা বলছে অবনী। যা মনে আসছে তাই বলছে মায়ের সাথে। হাতের ছোট্ট লাঠিটা দিয়ে মেঠো পথের দুধারের ঝোপ ঝাড়ের ডাল পাতা ভাঙতে ভাঙতে ও হেটে চলেছে। মায়ের কোন নিষেধই ও শুনছে না। নানা কথার ফুলঝরি বেরোচ্ছে ওর মখ দিয়ে। আস্তে হাটছে বলে মাকে বারবার মৃদু বকুনীও দিচ্ছে।
এ যেন অন্য এক অবনী। মুকচোরা ভীতু আর লাজুক অবনী আর ও নয়। ওর মাও তৃপ্তি ভরা অন্তর দিয়ে ওর প্রতিটি কথায় অংশ গ্রহন করছেন।
অবনী আসলে ঘরকুনো মুখবোজা ছেলে নয়। ওর মধ্যে প্রাণ আছে উচ্ছাস আছে। কথাটা ভেবে মায়ের মনটাও তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ।
নানা বাড়ীর গ্রামটা শুরূ হতেই ওর মায়ের সব পরিচিত মুখ। অবনীকে নিয়ে তিনি মেঠো পথ ছেড়ে সবার বাড়ীর উঠান দিয়ে দিয়ে হাটতে শুরু করলেন। ছোট বড় সবার সাথেই কিছু না কিছু কথা হচ্ছে রোকেয়া বেগমের। সবাই অবনীকে দেখে কেউ গালে মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ বা চুমু খেয়ে আবার কেউ কেউ বা ওকে কোলে নিয়ে আদর করছে। প্রথম কিছুক্ষন একটু জড়তা থাকলেও অবনী সহজ হয়ে ওদের নির্মল স্নেহভরা আদরে খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে লাগলো।
এক ঘণ্টার পথ প্রায় তিন ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে নানি বাড়ী পৌছালো ওরা।
খাওয়া দাওয়ার প্রতি আজন্ম অনীহা যে অবনীর এখানে এসে ওর যেন কোন কিছুর প্রতি যেন আর অরূচি থাকলো না। অবনীর প্রাণ খুলে দৌড়াদৌড়ী ছুটোছুটি আর পেঠ ভরে তৃপ্তি করে খাওয়া দাওয়া দেখে ওর মায়ের মনটা শান্তিতে ভরে গেল। অবনী যেন বুঝতে পেরেছে এখানে ও অনাকাঙ্ক্ষিত নয়।
দু তিন দিন পর অবনীকে নিয়ে রোকেয়া বেগম পাশের গ্রামেই গেলেন তার কবিরাজ দাদার কাছে।
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। চুল দাড়ি সব সাদা, চোখে পুরু গোল ফ্রেমের কাচের চশমা। খুক খুক করে কাশতে কাশতে লোহার একটা বড় বাটিতে গাছ পাতা শেকড় বাটছেন।
অবনীকে হাতে ধরে ওর মা বৃদ্ধের ঘরে প্রবেশ করলেন। একটু গলা উঁচিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। বয়সের ভারে বৃদ্ধ চোখেও কম দেখেন আর কানেও কম শোনেন। কথাও বলেন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে।
বৃদ্ধ হাতের কাজ ছেড়ে তাকিয়ে অবনীর মাকে চিনে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক কথা বললেন, নানা ভাবে প্রশংসা করলেন রোকেয়া বেগমের বাবার বাড়ীর মানুষদের।
কিছু কথা বার্ত্তা হওয়ার পর রোকেয়া বেগম অবনীর প্রসংঙ্গটা পাড়লেন।
বৃদ্ধ্ অবনীকে ওর কাছে টেনে খুব গভীর ভাবে দেখলেন কিছুক্ষন। ওর শীর্ণ শরীরটায় হাত বুলিয়ে বললেন- রোকেয়া তোর ছেলেতো শক্ত সামর্থ্যই, কোন অসুবিধা নেই এর। কোন চিকিৎসারও দরকার নেই।
তারপর অবনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন -তা ভাইয়া ভালভাবে খাওয়া দাওয়া করবে কেমন। মন খারাপ করে থাকবে না। অনেক দৌড়াবে, সবাইকে পিছে ফেলে আগে আগে দৌড়াবে, কেমন। দৌড়ে তোমার সাথে কেউ পারবে না, এ আমি বলে দিলাম।
বৃদ্ধ ওর নিজের কাজে মন দিতে দিতে রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন -ওকে নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা করবিনে। ওর কোন কিছুই লাগবে না। তোর ছেলে অনেক বড় হবে, নিজ গতিতেই চলবে ও। সে গতি থামাবার সাধ্য কার!
কি ভেবে বৃদ্ধ হাতের কাজ থামালেন ক্ষনেকের জন্য। অবনীকে কাছে টেনে নতুন করে আবার ওর মুখের দিকে তাকালেন। মনে হলো কি যেন একটা দেখার বাকি ছিল।
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন -অন্য কারো সাথে ওর মিল নেই। ও ওরই মত। তোর ছেলে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে দেখিস। ওর ভিতরকার লুকিয়ে থাকা নিজস্ব সত্ত্বাটা সহায় হবে ওর।
কথাটা শেষ করেই তিনি থামলেন একটু, একটা চাপা নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর কিছু না বলে বৃদ্ধ আবার নিজের কাজে মন দিলেন। তার আচরনে বোঝা গেল তিনি যেন আরও কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলেন।
রোকেয়া বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করতে দ্বিধা বোধ করলেন।
বৃদ্ধের কথাগুলো ওর মায়ের কাছে কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগলেও মনে মনে ভীষন খুশী হয়েছিলেন তিনি। কথাগুলো অবনীও শুনেছিলো কিন্তু ওর শিশু মনে তা কোন রেখাপাতই করতে পারেনি।

অবনী তখন ছোট, প্রায় বছর ছয়েক বয়স। শীতের দিন সকালে ভাই বোনরা মিলে গা গরম করার জন্য কিছু শুকনো কাঠ আর লতা পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে গা গরম করছে আর মজা করছে। স্বভাবতই ওটা জ্বালিয়ে রাখার জন্য পাশে স্তুপ করা শুখনো কাঠ আর লতা পাতার যোগান দেয়ার দায়িত্ব অবনীর উপর। ও অভ্যাসগত ভাবেই দেয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে।
তখনো আগুনের কদর্য রূপটা সর্ম্পকে অবনীর জ্ঞান খুবই সীমিত। সবাইকে খুশী রাখার জন্যই আর ওদের হাসি তামাসায় কোন বিঘ্ন না ঘটানোর প্রয়াসে অবনী ঠিক সময় মত আগুনের উপর কাঠ চাপিয়ে দেয়ার কাজটা আন্তরিক ভাবেই সম্পন্ন করছে।
কিন্তু হায়! ওর আন্তরিকতার অতিশয্যে পাশের স্তূপ থেকে কাঠ আনার সময় অসাবধানাবসতঃ মাটিতে পড়ে থাকা একটা কাঠের খন্ডের সাথে হোচট খেয়ে অবনী মুখ থুবড়ে জ্বলন্ত আগুনের উপর পড়লো। ওর আর্তনাদে টের পেয়ে ওর ভাইবোনরা ওকে টেনে তুললো। বাড়ীর অন্যান্য সবাই ছুটে আসলো।
যন্ত্রনায় অবনী জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। অনেকে ভাবলো ও বোধহয় মরেই গিয়েছে। ওর মা ডুকরে কেঁদে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি পাগলের মত চিৎকার করতে লাগলেন - তোরা ওকে বাচতে দিবি না।
যথাশিঘ্রি সম্ভব ওকে হাসপাতালে নেয়া হলো। মফঃস্বল শহরের ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করে তেমন অভয় দিতে পারলো না।
কিন্তু না, বিধাতা বোধহয় এখানেও স্বয়ং হস্তক্ষেপ করলেন।
সবাইকে তাক লাগিয়ে অবনী চোখ মেলে তাকালো।
শরীরের বেশ কিছু জায়গা পুড়ে গিয়েছে, কিন্তু চিন্তার কারণ হলো ওর ডান চোখের উপরে কপালটা অনেকখানি পুড়ে যাওয়াটা। চোখ সহ ডান কপালটা ব্যন্ডেজ করা।
সপ্তাহ খানেক ধরে চিকিৎসার পর ডাক্তার আশ্বস্ত করলেন জীবনের উপর হুমকি নেই। তবে ডান চোখটার অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
এবারেও বিধাতা আবার মুখ ফিরে চায়লেন। সকল আশংকাকে মিথ্যা প্রমান করে ওর চোখটা অক্ষত রয়ে গেল। অবনী ধীরে ধীরে ওর মায়ের চোখের অশ্রু মুছিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলো। শুধুমাত্র চোখের উপরে কপালের চামড়া পুড়ে যাওয়া কিছু ঘা বাদে।
সবাই বললো -ছেলেটা ভাগ্য কপালে, না হলে এত বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে এমনি ভাবে অক্ষত অবস্থায় বেচে যায়!
মা খুশীর অতিশয্যে অবনীকে বুকের মধ্যে নিয়ে খোদার কাছে শত কোটি বার কৃতজ্ঞতা জানালেন।
সময়ের আর্শিবাদে সব ক্ষতই শুকিয়ে গেল। কিন্তু সবার অলক্ষেই অবনীর শরীরের উপর একটা স্থায়ী ক্ষত পড়লো। ওর ডান চোখের প্রায় ইঞ্চি দেড়েক উপর দিয়ে কোনাকুনি ভাবে একটা পোড়া দাগ হয়ে রইলো ওর কপালে।
অনেকে যুক্তি দিল পরবর্তিতে সময় সুযোগ বুঝে বড় কোন হাসপাতালে একটা অপারেশান করে কপালের দাগটা মিটিয়ে দিতে। কিন্তু জীবন ফিরে পাওয়া আনন্দের অতিশয্যে কেউই ব্যপারটা গুরূত্বে আনলো না তখন। সবাই বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ডুবে থাকলো।
আপনজনদের কেউ কেউ বয়স বাড়লে মিলিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করলো। আবার অনেকে বললো -আরে পুরূষ ছেলে কপালে দাগ থাকলেই বা কি আসে যায়?
কপালে অমন কদর্যভাবে একটা পোড়া দাগ থাকলে কি আসে যায় তা বোঝার মত দূরদৃষ্টি অবনীর হয়নি তখন। আর যাদের একটু হয়েছিল সেই গুরূজনেরা অবনীকে আশেপাশের সকলের কাতারে বিচার করে এটা কোন বিশেষ কিছু না বলে উড়িয়ে দিলেন।
কপালে পোড়া দাগটা নিয়েই অবনী বড় হতে হলো। আর অনেকের অনুমান মিথ্যা প্রমানিত করে সকলের অলক্ষেই বয়স বাড়ার সাথে অবনীর কপালের পোড়া দাগটা ক্রমশ আরো পরিস্কার হয়ে উঠতে লাগলো।
অবনীর মা রাতে ঘুমানোর সময় কপালের পোড়া দাগটার উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দাগটাকে চুমুই চুমুই ভরে দিতেন। মনে মনে ভাবতেন খোদার অসীম করূনা আছে ছেলের উপর।
বড় ভাইদের পুরোনো জামা জুতার মত ওদের পুরোনো বই খাতা দিয়েই অবনীর লেখাপড়া শুরূ হলো। জীবন এগিয়ে চললো।
অবনী স্কুলে ভর্তি হয়ে সবার মত লেখাপড়া করতে লাগলো।
অন্য সবকিছুর মত এক্ষেত্রেও বিধাতা মনে হলো পুনরায় অস্বাভাবিকতার অবতারনা করলো। শুধুমাত্র অন্যান্য ভাই বোনের তুলনায় নয়, অন্যান্য সবার তুলনায় অসম্ভব রকমের মেধার পরিচয় দিতে লাগলো অবনী। তাতে ক্রমশ সবার দৃষ্টি ওর উপর পড়তে লাগলো।
সে থেকেই বোধহয় ওর কপালের পোড়া দাগটার প্রতিও সবার দৃষ্টি পড়তে শুরূ করলো। ওর স্কুলের বন্ধুদের কেউ কেউ ঈর্ষাবসত ওকে পোড়া কপালে বলে কটাখ্য করতে লাগলো। অধিকাংশরা ওর মেধার জন্য ওর প্রতি হিংসাবসত ওকে অবজ্ঞা আর হেয় করার জন্য পোড়া কপালে বলতো।
প্রথম প্রথম অবনী বিষয়টার প্রতি গুরূত্ব দিত না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটার প্রতি অবনী সতর্ক হয়ে উঠতে লাগলো। কাউকে প্রতিবাদ না করলেও আজকাল আয়নায় নিজেকে দেখার সময় দাগটা ওর কাছেও একটু একটু করে কদর্য মনে হতে লাগলো।
অন্তরে ব্যাথা পেয়ে ছোট্ট অবনী ওর মনের গভীরে ভাবতে শুরূ করলো প্রসঙ্গটা নিয়ে।
বন্ধুদের ঠাট্টা বিদ্রুপের কথা উল্লেখ করে অবনী বিষয়টা বাবার কাছে উপস্থাপন করলে বাবা মৃদু হেসে ব্যপারটাকে গুরূত্ব দিলেন না এবং এটাকে পাত্তা না দেয়ার জন্য ছেলেকেও পরামর্শ দিলেন।
-বন্ধুরা ওরকম একটু আধটু দুষ্টুমি করে, তুমি পাত্তা দিও না, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবার উপদেশে অবনীর মন কিছুটা হালকা হলো। যাহোক ওভাবে নিরেট অপ্রিয় বাস্তবতা নিয়েই ওর জীবনটা এগিয়ে চললো।