জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প 'মহাকালের মেইল ট্রেন'।

আপডেট: ১৬ জানুয়ারী ২০২৩, ১২:২০

মহাকালের মেইল ট্রেন

 

মেইল ট্রেনের যাত্রী অম্বর। ইচ্ছে করেই যে উঠেছে এ ট্রেনে তেমনটি নয়। জনাকীর্ণ স্টেশান, সে সময় তার জন্য যে কোন ট্রেনে উঠে সে স্থান ত্যাগ করার বিষয়টাই মুখ্য ছিল। বহমান স্রোতের টানে দুধারের খড় কুটো যেমন স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দেয় অনেকটা তেমনি এক টানে সে সময় সামনে যে ট্রেনটা ছেড়ে যাচ্ছিল সেটাতেই উঠে পড়েছিল অম্বর।
কোথাই যাবে, কত দূরে যাবে তার কোন কিছুই ওর চিন্তা চেতনার ভিতর ছিল না। ট্রেনে ও নিজেই উঠেছে সেটা ঠিক কিন্তু সেটা ওর ইচ্ছেই হয়েছে তেমনটি বলার কোন কারণ নেই।
সব মানুষই জীবনে অনেক কাজ করে যেটা নিজের ইচ্ছেই নয়, পরিস্থিতির কারণে করে থাকে।
সে সময়টাতে কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে ঠেলে এ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছে। কোথাই যাবে, কোথায় নামবে তার খোঁজ যদি কারো জানা থাকে তবে যৌক্তিক ভাবে যে শক্তি ওকে ট্রেনটাতে উঠিয়েছে তাঁর ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়।
ছুটে চলা ট্রেনের জানালা দিয়ে কত স্টেশান চোখে পড়ছে, কত লোকালয় মাঠ ঘাট, কিন্তু মেইল ট্রেনটা থামছে না কোথাও। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট স্টেশান পার হওয়ার সময় ভেপু বাজিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
তাতে অম্বরের কিছুই যায় আসে না, কারণ ওতো নিজের ইচ্ছেই বা কোন গন্তব্য চিন্তা করে বেছে বেছে এ ট্রেনে ওঠেনি। চলাতেই ওর যত আনন্দ, নামার কোন তাড়া নেই। ওসব নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যাথা নেই।
কিন্তু মাথা ব্যাথার কারণ সৃষ্টি করলো টিকিট কালেক্টর।

-টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠে তুমি অন্যায় করেছ। আর বলছ পকেটে টাকা পয়সা নেই টিকিট কেনার মত? এ অন্যায়ের শাস্তি তোমাকে ভোগ করতেই হবে।
টিকিট কালেক্টরের কথাই রীতিমত ঘাবড়ে গেল অম্বর।
শাস্তি স্বরূপ টিকিট কালেক্টর ট্রেনের চেইন টেনে একটা নাম না জানা অপরিচিত ছোট স্টেশানে অম্বরকে নামিয়ে দিল।
-টিকিট না কেটে ট্রেনে ভ্রমনের দায়ে তোমাকে এখানে নামিয়ে দিলাম। যাও উপার্জন করে জীবন কাটাও। ফিরতি ট্রেনে যখন উঠবে, তখন যেন টিকিট কেনার টাকা সাথে থাকে।
তারপর ভেপু বাজিয়ে চলে গেল ট্রেনটা।
স্টেশানটা একদম ফাঁকা। ট্রেনের বাইরে এসে ওর ভীষণ অস্বস্তি লাগতে লাগলো। বাইরের আলো বাতাস, প্রকৃতির শব্দ, কোলাহল ওকে চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওকে বিরক্ত করে ছাড়ল। বিরক্তিতে অম্বর চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।

পাহাড়ী এ অঞ্চলে এক কাঠ কুড়ানীর ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করল অম্বর।
এখানে আসবার সে ইতিহাস দিনে দিনে ও একেবারে ভুলে গেল। বলা যায় অতীত বিস্মৃত হয়ে বর্তমানকে নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো অম্বর।
আগে মায়ের সাথে কাঠ কুড়াতে যেত, এখন একটু বড় হওয়াই একাই চলে যায় গভীর জঙ্গলে কাঠ কাটতে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে উঠে মগ ডাল থেকে কুড়াল দিয়ে কাঠ কেটে সেগুলো বয়ে বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে ওর জুড়ী মেলা ভার।
গভীর জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনা ওর নেশা পেশা সব।

এভাবেই গভীর জঙ্গলে কাঠ কাটার কাজে ডুবে থেকে একদিন পথ হারিয়ে অম্বর পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে আটকে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে চারদিক আঁধারে ঢেকে যেতে লাগলো। মাথার উপর মেঘে ভরা কালো আকাশ, গুড় গুড় শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। হটাৎ একটা পড়ো বাড়ী নজরে পড়াই সেখানে আশ্রয় নেয়ার জন্য মনঃস্থির করল অম্বর।
দোচালা শনের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়ে ভাবল, রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালে রাস্তা খুঁজে বাড়ী ফিরে যাবে।
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই রাত যেন গভীর হয়ে গেল। তারপর আচমকায় বাতাসের ঝাপটায় সব মেঘ কেটে আকাশটা পরিষ্কার হয়ে নির্জনতাই চারধার ডুবে গেল। বাইরেটা স্বচ্ছ চাঁদের আলোই একটা নৈসর্গিক পরিবেশের অবতারনা করল।
অমরের দেহ মন জুড়িয়ে গেল। দুচোখ ঘুমে ভেঙ্গে আসতে লাগলো।
হটাৎ নির্জনতা ভেদ করে একটা সুরেল আওয়াজ কানে এসে লাগতে লাগলো অম্বরের। তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল ওর। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে সেটা বোঝার চেষ্টা করল।
মনে হল আওয়াজটা ঘরের ভিতর থেকে আসছে। ভাবল উঁকি দিয়ে দেখবে কিনা!
কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ঘরে উঁকি দিল।
ভিতরে যা দেখল তাতে ওর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে বুকের ভিতর ধড়ফড় করতে শুরু করল।
-কি দেখছে এ সব! মনে হল জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে আবার মেঝেতে বসলো অম্বর।
মনে পড়লো এ জঙ্গলের গভীরে একজন ধ্যানী পুরুষ বাস করে বলে ওর মা বলে মাঝে মাঝে। তাঁকে স্মরণ করে মাকে সকাল সন্ধ্যাই মাথা নোয়াতে দেখেছে অম্বর।
মা বলেছিল তিনি কারো কোন ক্ষতি করেন না। মায়ের সে কথা ভেবে মনে কিছুটা জোর ফিরে পেল অম্বর।
সে সব কথা ভাবতে ভাবতে বারান্দার মেঝেতে শুয়ে ওর দু চোখ ঘুমে বুজে আসতে লাগলো।
ঘুমে ঢুলে পড়ার আগে ওর মনটা আফসোসে ভরে উঠলো। ও ভাবতে লাগলো;
- বিধিকে স্মরণ করার কোন ভাষা বা কায়দা কানুন ওর জানা নেই, কিন্তু ওই ধ্যানী পুরুষের কত প্রগাড় জ্ঞান সে সম্পর্কে, তাইতো তিনি বিধির সাথে একাত্ম হয়ে কি অপরুপ স্বর্গীয় ছোঁয়াই আচ্ছন্ন হয়ে আছে! অম্বর শুধু জানে কি ভাবে জঙ্গলে এক গাছ থেকে গাছে উঠে গাছের মরা শুখনো কাঠ গুলো কাটতে হয়। এই একটি কাজে ও খুবই দক্ষ।
-হায়! বিধাতার সান্নিধ্য পাওয়াটা যদি গাছে উঠার মত কোন ব্যাপার হত, তাহলে সে ওই সিদ্ধি পুরুষের মত সহজেই বিধাতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারত।
আধো বোজা চোখে অম্বর দেখল সিদ্ধি পুরুষ ওর একেবারে সন্মুখে হাজির। ও ঘাবড়ে গিয়ে চমকে উঠে তাঁর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালো।
ভাবল গাছে চড়ার সাথে বিধাতার সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টাকে মিলিয়ে ফেলে ও একটা চরম অপরাধ করে ফেলেছে।
-আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা কর। আমি জন্ম মূর্খ, খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছি।
সিদ্ধ পুরুষ অপলক নেত্রে তাকিয়ে ওর দিকে।
-দেখ, আমার মাকে সেবা করা আর এই কাঠ সংগ্রহ নিয়েই আমার জীবন। আমি জ্ঞানত কোন গাছের কোন ক্ষতি করি না, আমার এই কুড়াল দিয়ে কেবল শুখনো ডালগুলোই কেটে নামাই। তাতে আমার অলক্ষে গাছের ডালে বাঁধা দুএকটা পাখীর বাসা হয়ত ভেঙ্গেছে স্বীকার করছি। কিন্তু ইচ্ছে করে কোন পাখীর বাসা আমি কখনো ভাঙ্গিনি।
-তবে একবার গাছ থেকে নামার সময় একটা পাখীর বাসা নজরে পড়াই দেখলাম তাতে দুটো ডিম। মনে খুব ইচ্ছে জাগল একটা ডিম খেতে। কোন পাখী আসে পাশে দেখলাম না। আমি একটা ডিম টুক করে ভেঙ্গে মুখে দিলাম, আর অসাবধানাবসত আঙ্গুলের ধাক্কা লেগে অন্য ডিমটা নিচে ঝরনার পানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পাথরের উপর পড়ে ভেঙ্গে গেল।
-সত্যি বলতে ডিমটা খেতে আমার তেমন স্বাদ লাগেনি, তবে স্বীকার করছি, কারো অলক্ষে ডিমটা চুরী করতে পারাতে মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির ভাব এসেছিল।
- কাঁচা ডিম খেয়ে মুখটা তেতো হয়ে যাওয়াই নিচে নেমে একটু ঝরনার জল মুখে দেয়ার জন্য পাথরটার উপর দাড়াতেই পা পিছলে পড়ে কোমরে ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন। ভাঙ্গা ডিমের কুসুম পড়ে পাথরটা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল।
-সেদিন কোমরের প্রচন্ড ব্যথা ছাড়াও কাঁচা ডিম খাওয়ার ফলে পেটে খুব ব্যাথা শুরু হয়েছিল। বেশ কয়েকবার বমিও হয়েছিল। কাজ ফেলে অনেক কষ্টে বাড়ী ফিরে শুয়ে পড়লাম। সে রাতে সারা রাত বমি হল, পেট কামড়াল আর কোমরের ব্যথায় একদম ঘুম আসলো না।
-বার বার মনে হয়েছিল এসব বোধহয় আমার পাপের ফল।
সিদ্ধ পুরুষ বিনা বাক্যে অম্বরের কথা শুনে ওর কাছ থেকে যেন নীরবে স্বীকারুক্তি আদায় করছিল।
-তোমার মত অতশত তো আর আমি জানিনে, শুধু মায়ের মুখ থেকেই শুনেছি তোমার কথা। একটা কথা আজ তোমাকে বলি, অন্য কাউকে বলার সাহস বা সুযোগ হইনি। আমি ভেবেছিলাম বিধাতা ঠিক আমার মায়ের মত দেখেতে। আমার মায়ের মত দয়ালু, সন্তানের সব অন্যায় আবদার মেনে নেয় আর ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেয়।
-পাখীর ডিম চুরি করে খাওয়ার কথা সেদিন মায়ের কাছে স্বীকার করেছিলাম। সে কথা শুনে আর কাঁচা ডিম খাওয়ার ফলে আমার কষ্ট দেখে সেদিন মায়ের মুখটা মলিন হয়েছিল। তা দেখে আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল। মাকে বলেছিলাম আমাকে মাফ করে দিতে। মা বলেছিলেন- খোকা, অপরাধ যার কাছে করেছিস মাফ চাইতে হলে তার কাছে গিয়ে চাইতে হবে।
-ওই বাসার পাখীদের আমি খুজে পায়নি, পাওয়া সম্ভবও না। ওরা হয়তো ভয় পেয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। জানো, আমার মনে সে অপরাধ বোধটা এখনো রয়ে গেছে।

পাখীর কিচির মিচিরে ঘুম ভেঙ্গে গেল অম্বরের।
-একি সে যে একটা স্টেশানের প্লাটফর্মে শুয়ে! খুব চেনা লাগলো স্টেশানটা।
আবছা মনে পড়ল ট্রেনটা এই স্টেশানে ওকে নামিয়েছিল।
দূর থেকে ট্রেন আসার আওয়াজ পরিষ্কার ভাবে তার কানে এসে লাগলো।
অম্বর বুঝলো যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
মনে পড়তে লাগলো মায়ের কথা। ছেলের অনুপস্থিতিতে মায়ের করুন মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
মনে হতে লাগলো ওকে ছাড়া ওর মায়ের দিন গুলো কেমন করে কাটবে! কে ওর মায়ের জন্য জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আনবে!
চোখের কোনা বয়ে অসহায়ত্বের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো অম্বরের।

মহাকাল যাত্রার মেইল ট্রেনটা নিঃশব্দে এসে প্লাটফর্মে থামল। 
সামনে দাঁড়ানো সেই টিকিট কালেক্টর!
তাঁকে দেখে সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গেল অম্বর।
সব ফেলে সব রেখে হাসি মুখে টিকিট কালেক্টরের হাত ধরে ট্রেনে উঠে মহাকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল অম্বর।