জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২০।

আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১১:২২

অম্বরাবনী-২০ 

অবনীর কিছু হল কিনা সে চিন্তাই উদ্বিগ্ন হয়ে ওর অফিসের সামনে দাঁড়ানো আরনাকে অভয় দিয়ে অবনী তাকে তার অফিসে ফিরে যেতে বলল।
হাতে লেখা নামবিহীন একটা এপ্লিকেশান।
সব প্রমান সহ তাতে লেখা -আরনা একজন প্রতারক, ও আসলে ক্লাস এইট পাশ কিন্তু জাল করে ম্যাট্রিক পাশের সার্টিফিকেট তৈরী করে এখানে চাকরী করছে। এই প্রতারককে চাকরী থেকে বহিষ্কার করা উচিত।
যে সমস্ত কাগজপত্র সংযুক্ত করা সহ অন্যান্য তথ্য দেয়া আছে তাতে অভিযোগটা যে সত্য তাতে অবনীর কোন সন্ধেহই নেই।
এপ্লিকেশানটা কয়েকবার পড়লো অবনী। তারপর সেটা ভাজ করে টেবিলে রখালো। আরনা চার চারটি ছোট ছোট সন্তানের বাবা। পুরো সংসারটায় এই চাকরীর উপর নির্ভরশীল।
অফিস টাইমের পর প্রায় প্রতিদিনই অবনীকে অফিসে কাজ করতে হয়। প্রায়ই সন্ধ্যা হয় অফিস বন্দ করতে। এধরণের কাজের সময় পিএ’র করনীয় খুব একটা কিছু থাকে না। এ ভাবে অযথা বসে না থেকে বাড়ী যাওয়ার জন্য অবনী ওকে অনেক ভাবে বলা সত্ত্বেও সেই রাত অব্দি অবনীর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরনা বসে থাকে।

চাকরীটা সম্পর্কে আরনার একটা বিশেষ আবেগ আছে। ও বলে চাকরীটা ওর ভাগ্যদেবতা। এই চাকরীর জন্যই ও বিয়ে করে সংসার করতে পেরেছে। এই চাকরীটাকে স্মরণ করে আরনা আর ওর স্ত্রী সকাল সন্ধ্যাই তুলসি মাকে পুজো করে।
এই চিঠিটা প্রকৃত অর্থে ওর আর ওর চার ছেলে মেয়ের পরিবারের ডেথ ওয়ারেণ্ট।

আরনা যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন ওর বাবা বোর্ড পরীক্ষার ফিস যোগাড় করতে ওর অপারগতার কথা জানায়। অশ্রুভরা চোখে আরনা ওর বাবার কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল, কিন্তু কোন ফল হয়নি। কথাগুলো বলতে বলতে আরনা একদিন কেদে ফেলেছিল।
গল্পের শেষটা কি হয়েছিল সেদিন আরনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু অবনী আজ পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছে যার পরীক্ষার ফিসই যোগাড় হয়নি সে কি করে পরীক্ষায় পাশ করবে?
কিন্তু গত বিষটা বছর ধরে তার জন্যতো আরনার দায়ীত্ব পালনে কোন অদক্ষতা পরিলক্ষিত হয়নি? বরং ওর কাজে আন্তরিকতার জন্য অবনী যখন নতুন জয়েন করে তখন মিশেল নিজেই আরনার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। মিশেলের দৃষ্টিতে ওর অফিসে আরনার মত দক্ষ আর নিবেদিত প্রাণ কর্মচারী দ্বিতীয়টি নেই।
গত প্রায় বছর দুই ও অবনীর সাথে কাজ করছে। অবনীর চোখে ওর কর্মদক্ষতা বা আন্তরিকতার কোন ত্রুটি কখনো ধরা পড়েনি। পড়বে কি করে, আরনা যে ওর দেয়া দায়ীত্বকে বিধাতার আরাধনা ভেবে তাতে মন প্রাণ ঢেলে দেয় নিজেকে বিলীন করে দেয়।

বেশ কিছুক্ষন অফিসের মধ্যে পায়চারী করল অবনী। আরনার অফিসটা অবনীর অফিসের সাথে লাগানো। সন্তর্পনে বের হয়ে ওর রূমে ঢোকার পর্দা টাঙানো দরজাটার সামনে এসে দাড়াল কিছুক্ষণ।
পর্দার ওপাশ থেকে আরনার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আপন কাজে নিমগ্ন আরনা। পর্দাটা একটু ফাক করতেই চোখে পড়লো প্রতিদিনের মত নিমগ্ন হয়ে আরনা চিঠিপত্র গুলো খুলে খুলে রেজিষ্টারে এণ্ট্রি করে সেগুলোতে সিল মেরে রেডি করছে। অবনী অফিসে আসার আগেই কাজগুলো ও শেষ করে। কিন্তু আজ তার অতি প্রিয় মানুষ অবনীর ব্যপারে উদ্বিগ্ন থাকায় কাজগুলো বোধহয় আগে করেনি। এখন অবনীর কাছ থেকে অভয়ের কথা শুনে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছে।
কাজের সময় গুন গুনিয়ে গান না গাওয়ার জন্য অবনীর কড়া নিষেধ থাকা সত্তেও কাজে নিমগ্ন আরনা আনমনে গুন গুন করে ওর প্রিয় গানের লাইন দুটো আওড়াচ্ছে –
মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না--।
ও আপন মনে গান গাচ্ছে, আর দিবা সপ্ন দেখছে। নিশ্চয় বড় কিছু পাওয়ার স্বপ্ন নয়। ওর ছেলেমেয়েদের নিয়ে, আর ওর ছোট্ট পৃথিবী নিয়ে, ছোট ছোট সুখ দুঃখের স্বপ্ন দেখছে আরনা।
কি নিষ্ঠুর নিয়তি আর নির্মম পৃথিবীর মানুষ!
অবনী এতদিন ভাবত অল্প শিক্ষিত ছাপোষা আরনা অর্থ না বুঝেই গানটা গায়। কিন্তু অবনীর আজ মনে হলো গানটার অর্থ আরনা বোঝে।
-হায়রে মানুষের অনর্থক শত্রুতা। কি আছে এই ছাপোসা মানুষটার, যে সেই লোভে এর প্রতি কোন মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়েছে। একটু হিংসা বা একটু রাগ চরিতার্থের জন্য এতগুলো নির্দোষ প্রাণ কি ভাবে হত্যা করতে পারে!
বিনা দোষে সাজাপ্রাপ্ত মানুষের চেহারাটা দেখার একটা ইচ্ছে অবনী আজন্ম মনের গভীরে লালন করতো। এধরনের মানুষের মুখের উপর কষ্টের রেখা গুলো কি ভাবে ফুটে ওঠে তা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল অবনীর।
মনে হলো আরনাকে ডাক দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে দেখবে সেটা অবনী। কিন্তু না, এ মুহুর্তে আরনার অভিব্যক্তিটা সম্পূর্ণ আলাদা।
-হিংস্র জানোয়ারের মুখোমুখি পতিত হওয়া কোন মানুষ নিশ্চিত নির্মম মৃত্যুর আশঙ্কার ছায়া ফুটে ওঠে তার চোখে মুখে, আর বাচার জন্য দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি করে। কিন্তু সে রকম কিছুই আরনার দেহ ভঙ্গিমায় নজরে পড়ল না অবনীর। কারণ আরনা যে এক ওৎ পেতে থাকা গুপ্ত এক বিষধর সাপের লক্ষবস্তু।
ভাবল অবনী।
-কি ভয়ংকর আর অসহনীয়! মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি তার দন্ড সম্পর্কে অজ্ঞাত!
কি করবে অবনী!
নিজ অফিসে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর এপ্লিকেশানটা নিয়ে সোজা মিশেলের রূমে গেল অবনী।
-স্যার, আমি তদন্ত করতে চায়না, কারণ সব অভিযোগ সত্য!
মিশেল অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে।
-স্যার, আরনা প্রায় বিশ বছর ধরে আপনার অফিসে কাজ করছে। আমার সাথে প্রায় দুই বছর। ওর আন্তরিকতা আর দক্ষতার একটুও কমতি নেই। আমি এপ্লিকেশানের উপর লিখে দিচ্ছি, তদন্ত পূর্বক অভিযোগ ভূল প্রমানিত হয়েছে।

অবনীর এ ধরনের রিপোর্টের পর আরনার চাকরীটা সেদিন যায়নি।
সেটাই কি অবনীর সততাহীনতা! যার দিকে ইন্টারভিউ বোর্ডের ষষ্ঠ সদস্য ইঙ্গিত করছেন!
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ষষ্ঠ প্রশ্নকারীর সততার প্রশ্নে অবনী ভাবছিলো কথাগুলো।
এই মূহুর্তে অন্য আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়লো অবনীর।
ওদের কোম্পানী দারীদ্রমোচনের একাধিক প্রোজেষ্ট হাতে নেয়। এমনই একটা প্রজেক্টে শহরের বস্তিবাসীদেরকে টার্গেট জনগোষ্ঠি ধরে ওদেরকে তালিকাভুক্তির দায়িত্ব অবনীর উপর পড়ে। সংগত কারণেই তালিকা থেকে সকল সমাজ বিরোধীদেরকে বাদ দেয়ার জন্য বলা হয়।
বেশ কয়েক মাস ধরে অবনী সব বস্তি ঘুরে ঘুরে তালিকা তৈরীর কাজ করে। এ কাজ করতে যেয়ে অবনীর সামনে নতুন এক পৃথিবী উন্মোচিত হয়। মানুষ সম্পর্কে অদ্ভুত তথ্য আর মানুষের দেখানো বা দেখা যাওয়া মুখের পিছনে অন্য মুখের সন্ধান লাভ করে অবনী।
ক্ষুধা দারীদ্রতা মানুষের ভিতর থেকে বিবেকটাকে গলা টিপে শ্বাস রোধ করে দেয়। বিবেকহীন হয়ে শরীর সর্বস্ব মানুষগুলো কেবল শারীরিক শক্তির উপর নির্ভর করে কেউ বা সত্রাসী, সমাজবিরোধী আবার কেউ বা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। ক্ষুধার তীব্রতা আর জীবন বাচানোর তাগিদ ওদেরকে সব ধরণের কাজ করতে বাধ্য করে।
ওদের এই দুর্বলতার পুরোপুরি সুযোগ নেয় সমাজের একশেণীর ভদ্রবেশী মানুষ। যারা এদেরকে দিয়ে যা ইচ্ছা করিয়ে নেয়।
এই অনন্যপায় মানুষগুলো সমাজপতিদের সব ধরনের খেয়ালভিত্তিক গবেষনার গিনিপিগ হিসাবে কাজ করে। এ পথে এগোতে এগোতে এরা এক একজন এমন ধরণের কানা গলিতে আটকে যায় যেখান থেকে ফিরে আসার সকল পথ রূদ্ধ করে দেয়া হয়।
এদের সবার নামই অবনী তালিকাভুক্ত করলো। যার মধ্যে অনেকেই ছিল নিরাপত্তা বহিনীর খাতায় নথিভুক্ত আসামী।
চিহ্নিত সমাজ বিরোধীদের নাম বাদ দিতে বলেছিল মিসেল। কিন্তু অবনী তা দেয়নি। ওর মতে ওরা সমাজবিরোধী কাজে জড়িত হয়েছে ওদের দারীদ্রতার জন্য, তায় দারীদ্রতা দুর করলে ও পথ থেকে ওরা ফেরত আসবে আর তাতে প্রকৃতই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
মিসেলের সাথে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছিল এটা নিয়ে। কিন্তু অবনী সেদিন ওর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসেনি। ওর দেয়া রিপোর্টটাতে ও লিখে দিয়েছিল যে ওদের বিরুদ্ধে সমাজবিরোধী কাজের রিপোর্ট ওরা সমাজবিরোধী নয়। কেবল দারীদ্রতার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ওদেরকে দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়ে ওদেরকে প্রচলিত আইনের চেখে সমাজবিরোধী বানিয়েছে।

অন্য পাচজন প্রশ্নকারী তেমনি ভাবেই কিছুটা হতভম্ভ। আর ষষ্ঠজন মনোযোগ সহকারে ঝানু ডিটেকটিভের মত করে ফাইলের সব তথ্য ব্যস্ত ভাবে খুজতে ব্যস্ত।

এছাড়া অসততার আর কোন ঘটনা অবনী মনে করতে পারছে না এই মুহুর্তে।
অসততার প্রশ্ন যেহেতু তিনি তুলেছেন প্রমান অবশ্ব্যই আছে তার কাছে। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় যার উপর এই দোষারোপ করা হচ্ছে সেই অবনীই ওর সমস্ত স্মৃতির পাতা এক এক করে ওলট পালট করেও তার সন্ধান পাচ্ছে না।
অপরাধী সারা দুনিয়ার চোখে ধুলো দিতে পারলেও নিজের বিবেককে কখনও ধোকা দিতে পারে না।
কিন্তু অবনীর মনে কোন অপরাধবোধই হচ্ছে না।