জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ'' পর্ব -১।

আপডেট: ০৭ মে ২০২৩, ১৪:৫৮

জীবনের অন্যপিঠ-১ 

 

প্রায় দুশো বছরের পুরানো অমৃতগড়ের জমিদারী। প্রথম চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আর তাঁর মহানুভবতার কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে। তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন এ অঞ্চলের সব মানুষের অন্তরে।
প্রথম চৌধুরীর আসল নাম আসগর চৌধুরী যিনি প্রকৃত অর্থে এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজদের কাছ থেকে চৌধুরী উপাধী গ্রহন করে তিনিই এ বংশের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাই তিনি প্রথম চৌধুরী বা বংশপিতা নামেও পরিচিত।
জমিদার আসগর চৌধুরী তাঁর সব কল্পনার সাথে মনের মাধুরী দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ একর জমির উপর নির্মান করেছিলেন চৌধুরী এষ্টেট। দেয়াল ঘেরা চৌধুরী এষ্টেটের ভিতর প্রকৃতিকে দেয়াল বন্দি করে আসগর চৌধুরী তার কল্পনার স্বর্গরাজ্য রচনা করতে চেয়েছিলেন। নানা স্থাপনা ছাড়াও প্রকৃতিকে তার কল্পনার আদলে সাজিয়ে বাছাই করা অরণ্যের সবুজ ভূবন গড়েছিলেন তিনি।
প্রকান্ড বসতবাড়ী বাদে বাকি জায়গা প্রকৃত অর্থে নানা জাতের বৃক্ষরাজীর এক অভয়ারণ্য। তিনি তার সবটুকু অবসর সময় কাটতেন ঐ সমস্ত বৃক্ষরাজীর পরিচর্যা করে।
সবুজের স্বর্গরাজ্যে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা চৌধুরী এষ্টেটের বিশাল প্রধান ফটকটার দুধারে বিরাট দুটো বেঙ্গল টাইগারের মর্মর মূর্তি। শক্তি আর ক্ষিপ্রতার সাথে সৌম্যের এক মহা মিলনের প্রতিভূ হয়ে দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে আসগর চৌধুরীর দেয়াল ঘেরা স্বপ্ন আর তাঁর রচিত বংশের সব অতীত ঐতিহ্য।
আসগর চৌধুরী বলতেন -চৌধুরী এষ্টেটের গাছ গাছালী কথা বলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলতো আসগর চৌধুরী একাকী বিড় বিড় করে গাছ পালার সাথে কথা বলতেন। স্ত্রী সন্তানদের তিনি বলতেন -এদেরকে ভালবাসলে এদের সাথে কথা বলতে পারবে। আমাদের মত এদেরও অনুভব অনুভূতী আছে, অভিমান আছে রাগ আছে ক্ষোভ আছে।
শোনা যায় আসগর চৌধুরী মৃত্যুর কয়েকদিন আগে খুব অসুস্থ অবস্থায় ঘরের চার দেয়ালের ভিতর তার দম বন্দ হয়ে যাওয়ার মত হতো। তাই মহল ছেড়ে তিনি স্ত্রীর হাত ধরে এসে এই গাছের ছায়ায় শুয়ে চোখ বন্দ করতেন। পরে এই গাছের সুশীতল ছায়াই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
একজন মানুষের নিজের পরিচিতি সম্পর্কে আসগর চৌধুরীর কিছু নিজস্ব ধ্যান ধারণা ছিল। তিনি বলতেন প্রকৃত অর্থে নিজস্ব জন্মস্থান একজন মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। জন্মস্থানই একজন মানুষের প্রকৃত পরিচিতি দেয়। মানুষের আত্মার প্রকৃত প্রশান্তি দিতে পারে কেবলমাত্র তার জন্মস্থান।
তিনি বলতেন নিজের জন্মস্থান ছাড়া অন্য যে একটি জায়গাই ঘর বাধা যায় সেটি হলো দেশের রাজধানী। নিজের জন্মস্থান যেমন নিজের তেমনি দেশের রাজধানী সবার নিজের। এ দুটো স্থান বাদে অন্য জায়গাগুলোকে কখনো আপন করা যায় না। কিছু সময় হয়তো কাটানো যায়, সামর্থ্য থাকলে হয়তো অট্টালিকা বানানো যায় কিন্তু ঘর নয়।
এ দুটো জায়গা বাদে অন্য সব জায়গাতেই মানুষ পরবাসী।
তিনি এই জমিদার বাড়ীটা বাদে রাজধানী শহরে বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরী করেছিলেন ‘চৌধুরী লজ’।
জমিদারীকে কখনই তিনি অর্থ উপার্জন বা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেননি। জমিদারীকে প্রকৃত অর্থে একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করতেন এবং প্রজা সেবা করা জমিদারের একটা কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতেন।
তারপর আরো তিন পুরুষ গত হয়েছে। সবাই মোটামুটি প্রথম চৌধুরীর পদাঙ্ক অনুসরন করে সে ভাবেই চালিয়েছেন জমিদারী।

অমৃতগড়ের বর্তমান জমিদার অমর চেীধুরী, বয়সে তরূন আর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। বিলেতে লেখাপড়া করেছে এবং সে জন্য ওর জীবনের বড় একটা সময় সেখানেই কাটাতে হয়েছে।
বিজনেস এ্যাডমিনিসট্রেশানে পড়াশোনা সবে শেষ হয়েছিল। রেজাল্টের অপেক্ষা করছিলো অমর, ঠিক তখনই বাবার মৃত্যুসজ্জার সংবাদে ছুটে এসে জমিদারীর হাল ধরতে হয়েছে।
বয়স পচিশের কোটা ছুঁই ছুঁই। সুঠাম দেহের অধিকারী বর্তমান জমিদার সনাতন মতবাদে একদম বিশ্বাসী নয়। অর্থনৈতিক উন্নতীর মধ্যে প্রজাদের কল্যান নিহীত বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
তিনি সততায় বিশ্বাসী। আর তার সততাবোধ অংকের হিসাবের মত। যার যা অর্জন তা তাকে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিবেন। জমিদারী চালানোর ব্যপারে কোন বদান্যতায় তিনি বিশ্বাসী নয়। তার মতে বদান্যতা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এটার সাথে জমিদারী পরিচালনা কোন রকমে মিশ্রিত করা সঠিক নয়।
জমিদার অমর চৌধুরীকে বুঝতে কারো বিশেষ কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ সব কিছুই তিনি লিখিত নিয়মে পরিচালনা করেন।
জমিদারী বুঝে নেয়ার পর প্রথম যে কাজটি তিনি করলেন সেটা হলো প্রতিটি কার্য্য পরিচালনার ব্যাপারে লিখিত নীতিমালার প্রচলন করা।
পরামর্শদাতাদের মধ্যে যারা গুনিজন ছিলেন তাদেরকে কাজে লাগিয়ে যে সমস্ত ব্যপারে লিখিত নীতিমালা ছিল সেগুলো বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির নিরীখে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করলেন। আর যে সমস্ত ব্যপারে কোন নীতিমালা ছিল না সেখানেও সুচিন্তিত নীতিমালা প্রনয়ন করলেন।
সবকিছুরই নীতিমালা বেধে দিয়ে বিষয়গুলো সবার বোধগম্য এবং সরলীকরন করলেন বর্তমান চৌধুরী। নীতিমালা গুলো সবই জমিদারী তথা সকল প্রজা কল্যানের কথা বিবেচনায় রেখেই রচিত হয়েছে।
বর্তমান চৌধুরীর হিসাব অনুযায়ী জমিদারী সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্য্য পরিচালনার ব্যপারে কারোরি ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করে কাউকে আনুকল্য প্রদর্শন আবার কাউকে বঞ্চিত করার অবকাশ তিনি বন্দ করেছেন।
সবকিছুকেই নিয়মের বন্ধনে কঠোর ভাবে আবদ্ধ করছেন।
কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মোদ্দিপনা বাড়ানোর জন্য তিনি বিভিন্ন ভাতার প্রথা চালু করছেন। কৃষক শ্রমিকদের উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে তিনি অনেক ধরনের উৎসাহ ভাতারও প্রচলন করছেন।
সত্যি কথা বলতে কি বর্তমান চৌধুরী জমিদারী চালানোর পুরো ব্যপারটিই ঢেলে সাজিয়ে আধুনীকরন করছেন।
তার গৃহীত পদ্ধতিসমুহ যে কোন মাপকাঠিতেই ন্যায্য, প্রগতিশীল এবং জনকল্যানকর বলা যায়।
অল্প দিনের মধ্যেই বাবা আমির চৌধুরীর আমল থেকে ঝিমিয়ে পড়া জমিদারীর প্রভূত উন্নতি সাধন করে সব কিছুতে যেন প্রাণ সঞ্চার করেছে বর্তমান চৌধুরী।
নতুন নতুন রাস্তা ঘাট, বাজার, স্কুল কলেজ সবই হচ্ছে। এত অল্প সময়ে এত সব উন্নতির জন্য তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে।
বাবার অকাল মৃত্যুতে ঝড়ো হাওয়ার মত বিদেশ থেকে এসেই তিনি কালক্ষেপন না করে নিজেকে জমিদারীর কাজকর্মে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছেন।
প্রথম চৌধুরীর আমল থেকেই চৌধুরী বাড়ীর সামনে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। ঐ চিকিৎসালয়টি মূলতঃ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক চিকিৎসার আলো যখন এ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছায়নি সে সময় থেকেই এই দাতব্য চিকিৎসালয়টি এতদঞ্চলের মানুষের একটা অন্যতম চিকিৎসা কেন্দ্র।
প্রথম চৌধুরী অখন্ড ভারতের দক্ষিণের কোন রাজ্য থেকে একজন আয়ুর্বেদকে নিয়ে আসেন। মোটামুটি তারই অক্লান্ত পরিশ্রম আর জমিদারের ঐকান্তিক সাহায্য সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল চিকিৎসালয়টি।
এটাকে ঘিরে ঐ আয়ুর্বেদী ধীরে ধীরে নানা ধরণের ঔষধি গাছের একটা প্রকান্ড বাগানও গড়ে তোলেন।
তারপর অনেক বছর অতিবাহিত হয়েছে। চিকিৎসালয়টির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুন। আর ঔষধি বাগানটাকে ঘিরে ছোটখাটো ঔষধ তৈরীর ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে।
অখন্ড ভারতের দক্ষিনাঞ্চল থেকে আসা কাজ পাগল আয়ুর্বেদী আর ফেরত যায়নি এখান থেকে। কাজকে ভালোবেসে, এখানকার মানুষদেরকে আর চৌধুরী এষ্টেটকে ভালোবেসে এখানেই সংসার পেতে থেকে গিয়েছে। আর ওরা বংশপরস্পর এই পেশায়ই জড়িত আছে।
প্রথম চৌধুরীর আমল থেকে জমিদার পত্নিরাই এই প্রথিষ্ঠানের যাবতীয় কার্য্যাদি পরিচালনা করেন। চৌধুরী পত্নিরা আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সে হিসাবেই এটা সবার কাছে চৌধুরীমাতা দাতব্য চিকিৎসালয় বলেও পরিচিত।
এই চিকিৎসালয়ের সাথে জড়িতরা জমিদার প্রাসাদ সংলগ্ন চৌধুরী এষ্টেটের সম্পত্তির আয় থেকে ভাতা পেয়ে থাকে। এদের বসবাসের ব্যবস্থাও জমিদার এষ্টেটের ভিতর। এ ব্যবস্থাটাও বংশপরস্পর।
এতকিছু যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলা হচ্ছে এটার বর্তামান পরিচালক সদ্যমৃত আমির চৌধুরীর পত্নি, অর্থাৎ বর্তমার চৌধুরীর মা নীলিমা চৌধুরী।
বস্তুতঃ চৌধুরী এষ্টেটের সাথে তার পরিচিতি নেই বললেই চলে। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে ছেলার মত তিনিও হটাৎ করেই কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সব ছেড়ে এখানে বসবাস করতে এসেছেন।
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান নীলিমা চৌধুরী।
এখানে আসার পর থেকেই হতবিহবল হয়ে আছেন। বলতে গেলে জমিদারীর কোন কিছুরই খোজ নেননা তিনি।
দাতব্য চিকিৎসালয়টি বর্তমান জমিদারের সংস্কারের আওতায় আসার ফলে এর কার্য্যক্রম মোটামুটি বন্দ আছে। ভবিষ্যতে কি হবে তা কেবল কল্পনার বিষয়।
অমর চৌধুরীর দৃষ্টিতে বর্তমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসার যুগে এ ধরনের চিকিৎসার উপযোগীতা শুন্যের কোটায় পৌছেছে। এ ধরণের চিকিৎসা রোগীকে ভালো করার পরিবর্তে দীর্ঘসূত্রিতার জন্য বরং আরো খারাপ করে বলে ধারণা পোষন করেন তিনি।
ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে, কিন্তু তার কথাই এটাকে পিরামিডের মমির মত জড় পদার্থে পরিণত করতে চান না বর্তমান জমিদার। চিকিৎসালয়টিতে পাশ করা ডাক্তার নিযুক্ত করে আধুনিক উপায়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার ঐতিহ্যকে যুগোপযোগী করে ধরে রাখার পক্ষপাতী বর্তমান জমিদার।
চৌধুরীমাতা দাতব্য চিকিৎসালয়ের বর্তমান চিকিৎসক রামদয়াল ডিসুজা, ডিসুজা বংশের চতুর্থ প্রজন্মের সদস্য। বয়সটা ত্রিশের কোঠা ছাড়িয়েছে। বংশানুক্রমে দায়ীত্বটা পেয়েছে ও। রামদয়াল ওর বাবার সহচর্য্যে এ চিকিৎসা বিদ্যাটি শিখে বলতে গেলে আজন্ম এর সাথে জড়িত।
রামদয়ালের শরীরের বয়সটা প্রকৃত বয়স থেকে কম করে হলেও দশ বছর বেশী মনে হয়। মোটা গ্লাসের চশমা পরে। চশমা ছাড়া মোটামুটি অন্ধ রামদয়াল। সবসময় হাতে একটা লাঠি নিয়ে কিছুটা কঁজ্ঞো হয়ে হাটে।