জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২৩।

আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৩, ১২:৫৭

অম্বরাবনী-২৩ 

 

এত বছর পরে ফেরা, তারপর কোন রকম খবর না দিয়ে। অবনীকে দেখে চিনতে পারেনি বাড়ীর পুরনো কাজের মানুষ আল্লারাখা প্রথম। আর অবনীর এভাবে আসাটা যে ওর স্বপ্নের অতীত। পরিচয় দেয়ার পর আৎকে উঠে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিল।
নিজের বাড়ীতে নিজেই অপরিচিত অবনী!
নিজের নতুন পরিচয় সৃষ্টি করতে যেয়ে অবনী ওর নিজের বলতে যাকিছু ছিল, অতীত বর্তমান তার সবটুকুকে দুরে সরিয়ে দিয়ে নিজের চোখকে পর্যন্ত ফাকি দিয়েছে। কিন্তু অন্য মানুষের চোখকে ও কিভাবে ফাকি দেবে। ওর নতুন পৃথিবী, যেখানে অবনী জীবনের বেশী সময়টা কাটিয়ে দিয়েছে সে জগতটা এখন অপরিচিত বলতে গেলে মৃত। আর পুরনো পৃথিবীতেও নতুন করে পরিচয় করে নিতে হচ্ছে।
একটু উষ্ণতার সন্ধানে ও যখন পুরনো পৃথিবীতে ফেরত এসেছে ততোদিনে এ জায়গাটাতেও সে অপরিচিত। যেখান থেকে ফেরত আসলো সেটা ওর আপন নয়, যেখানে আসলো এটাও ওর পর হয়ে গেছে।
আমাদের এই পৃথিবীতে বসবাস কাজ কর্ম এর সব কিছু যদি একটা স্বপ্ন হয়, আর সে স্বপ্ন ভেঙে যদি আমারা নিজেদেরকে অন্য কোন জগতে দেখতে পাই, তাহলে কি অবস্থা হবে সেটা কল্পনাতীত।

অবনী আসলে দোতলার ঘরটাতে থাকে। তায় সব কিছুই আছে সেখানে। কেবল একটু ঝাড়া মোছা করলেই চলবে।
আল্লারাখা ওর পিছু পিছু ঘরে ঢুকলো।
-তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও আমি একটু ঝাড়ামোছা করে দিচ্ছি। দীর্ঘ দিনের জঞ্জাল জমেছে। অল্প ঝাড়ামোছায় কাজ হবে না।
কিছুটা স্বগতঃ ভাবেই শেষের মন্তব্যটা করলো আল্লারাখা।
অবনী বাথরূমে ঢুকতে ঢুকতে বললো - বেশী ঝাড়া মোছার দরকার নেই এখন। আর রান্না বান্নারও দরকার নেই, আমার কাছে যা শুখনো খাবার আছে তাতে আপাতত চলে যাবে।

সময়টা ভরা আষাঢ়। আর সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢেকে সব অন্ধকার প্রায়। একটুও যেন বাতাস নেই। একটা পাতাও নড়ছে না। মনে হছে হতবাক হয়ে আছে পৃথিবী। মেঘ গুড়ু গুড়ু শব্দে চাপা আওয়াজ করছে। যে কোন যেন সময় মাতন শুরূ হবে।
-চোখ বোজার আগে তোমার বাবা খুব দেখতে চেয়েছিল তোমাকে। সবাইকে মিনতি করে বলেছিলো তোমাকে খবর দিয়ে আনার জন্য।
আল্লারাখার কথায় অবনীর মনে হলো ও যেন কোন বড় অপরাধে জেল বন্দি ছিল, আসার কোন উপায় ছিল না, ছাড়া পেয়ে এখন এসেছে। মনে হচ্ছে জীবনটা ওর জেলেই কেটেছে এক জেল থেকে অন্য জেলে। কোন মহাপাপের মেয়াদী আসামীর মত।
আল্লারাখাকে পাল্টা কিছু বলার সাহস হলো না।
-তোমাকে একটু দেখার জন্য খুব ছটফট করেছিলেন তিনি। তার জন্য সবাই বিরক্তও হয়েছিল তোমার বাবার উপর। সবাইতো আছে তবু কেন তোমার কথা বলছে বারবার।
আল্লারাখা ওর ঘাড়ের গামছার কোনা দিয়ে কোঠরাগত চোখদুটো মুছতে লাগলো।
-আমার একদম ভালো লাগিনি। সবাই জানে মানুষটাতো চলেই যাচ্ছে তাহলে সবার একটু ধৌর্য্য ধরলেই হতো। বিরক্তির শিকার হয়ে মনের কষ্টে তোমার বাবা কথা বলা বন্দ করে দিলেন। মরার আগ পর্যন্ত আর একটা কথাও বলেনি।
ঝাড়া মোছা করতে করতে আল্লারাখা ডুকরে কেদে উঠলো।
-বাকি দিন গুলোতে তোমার বাবার চোখ দুটো গড়িয়ে শুধুই পানি পড়তো।
নিজেকে একটু প্রকিতিস্থ করে নিল আল্লারাখা।
-তোমার বাবা প্রায়ই আমাকে বলতো -আল্লারাখা সব ঠিকঠাক মতো সামলে রাখবি, দেখিস খোকা একদিন না একদিন ফিরে আসবেই।

-সেইতো আসলে ফিরে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানলো আল্লারাখা। মনে হলো নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ওর অপেক্ষার পালা শেষ হওয়াই একটা স্বস্তি অনুভব করলো।
-তোমার বাবা মরার পর আমিও সব ছেড়ে চলে যেতাম। বল কার মন চায় এ খালি ভিটে আগলে থাকতে। আমার নিজের কেউ থাকে এখানে! কিন্তু তোমার বাবার কাছে দেয়া কথা আমি খেলাফ করতে পারিনি।
খোলা ছাদে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। জোরে নিঃশ্বাস টেনে শুন্য বুকটা ভরে নিলাম।
জমাট কালো পাথরের মত হয়ে আছে আকাশটা।
যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ে সমস্ত গুমোট ভাব কাটিয়ে দেবে। সব কিছুই শান্ত শীতল হয়ে যাবে।
এমন অবস্থা কাটাতে আকাশ ফুটো করে বৃষ্টি হওয়া দরকার। বৃষ্টির পানি ধুয়ে মুছে সব জঞ্জাল সাফ করে দেবে। ভাবলো অবনী।
সব বাধন মুক্ত হয়ে, সব শৃংখল ভেঙে কালো মেঘের বুক চিরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা বৃষ্টি আকাশ চিরে বেরিয়ে আসার সময় আসন্ন। প্রকৃতির সব ধুলো ময়লা, জমে থাকা আবর্জনা সব ধুয়ে মুছে ধরিত্রির কোলে আছড়ে পড়ে সব জ্বালা জুড়ানোর তোড় জোড় প্রায় সমাপ্ত। সব প্রস্তুত, মনে হচ্ছে এখন কেবলমাত্র কোন একটা ইংগিতের অপেক্ষায়।
অবনীও প্রস্তুত।
আল্লারাখাকে ইজি চেয়ারটা নিচের তলার বারান্দায় লাগিয়ে ওকে বিশ্রাম করতে যেতে বলল অবনী।
এত উপর থেকে নয়, একদম কাছ থেকে স্বাদটা গ্রহন করতে চায় অবনী। আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে হলে, আর আকাশের সাথে মাটির আলিঙ্গনের গন্ধটা উপভোগ করতে হলে এত দূর থেকে নয়, অনেক কাছ থেকে তা দেখতে হবে।
উপর থেকে সিড়িগুলো এক এক করে টপকিয়ে নেমে আসতে অনেক কষ্ট হতে লাগলো অবনীর। লিফটে উঠা নামা করতে করতে উঠা আর নামার মধ্যে যে ব্যবধান, যে কষ্ট তা একদম ভুলেই গিয়েছিল অবনী।
পুরনো ধাঁচে তৈরী বাড়ী, উচু ছাদ সিড়িগুলোও সরূ আর খাড়া। উঠার সময় তাড়াহুড়া ছিল, উপরে উঠার চিরন্তন নেশাগ্রস্থ সে, এক নিঃশ্বাসে উঠে গিয়েছে তায় সময় কতটা লেগেছে বোঝা যায়নি।
প্রকৃত পক্ষে এই বোঝা যাওয়াটাই সব সমস্যার মুল। বোঝা না গেলে কোন সমস্যা হয় না, মনে হয় সব ঠিকঠাক চলছে। সার্জন দেহটা অবস করে নিয়ে সেটার উপর যখন ওর ছুরি কাচি চালায়, তখন চামড়া মাংস কেটে যায়, রক্তক্ষরণ হয় কিন্তু কিছুই বোঝা যায় না।
কি সুন্দর ব্যবস্থা। আহ! মানুষের জীবনটা যদি এমন হতো!
নামতে নামতে কথাগুলো ভেবে একটা বড় নিশ্বাস ছাড়লো অবনী।
খাড়া নামতে বেশ কষ্ট হতে লাগলো। আর নামার সিড়িগুলোও তো অচেনা অন্ধকার। এভাবে অসময়ে নামতে হবে তাতো কখনো ভাবিনি অবনী। কিন্তু নামতে ওকে হবেই।
নামার জন্যইতো প্রস্তুত হয়ে এসেছে অবনী।
এক এক করে সবগুলো সিড়িই নামলো অবনী।
সিড়ির শেষ ধাপটা নেমে দেয়ালের গায়ে হাতটা ঠেকিয়ে পিছন ফিরে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটু।
থমকে দাড়ালো কিছুক্ষন ওভাবেই। খাড়া সিড়ি, অন্য সব সিড়ির মত ক্রমোন্নতি না হয়ে বেশ খাড়া ভাবে উঠে প্রায় মাঝ পথে একটা মোচড় খেয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। ওপরের তলাটা যে এতটা উপর তা এর আগে কখনো খেয়াল করিনি অবনী।
সিড়িটা এত খাড়া ভাবে কেন যে তৈরী করা হয়েছিল তা মনে নেই ওর। বোধহয় মূল নক্সার গন্ডোগোল। হাতুড়ে মিস্ত্রির গড়া নক্সা, অন্যান্যদের মত কোন নিপুণ স্থপতির ছোয়া তাতে ছিল না। সিড়িটা এত খাড়া ভাবে তৈরী না হলেই ভালো হতো। ভাবলো অবনী।
বুকটা খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
নিচে যখন নেমেই এসেছে তখন ও সব ভেবে আর লাভ কি। কথাটা ভেবে নিজেকে কিছুটা হালকা মনে হলো।