জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১৬।

আপডেট: ২৭ অগাস্ট ২০২৩, ১৩:০৪

জীবনের অন্যপিঠ- ১৬ 

 

-আমার সামান্য যুক্তিটা ওরা ওদের এত বড় একটা কঠিন প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব হিসাবে ওরা এত সহজেই মেনে নিল! বুঝলাম যুক্তি নয়, আমার মত এত বড় মাপের একজন মানুষ ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করছে ওদের চোখে সেটায় মুখ্য বিষয়। অবাক হলাম, এই সব সাধারণ মানুষের চোখে আমার অবস্থানটা নতুন করে আবিষ্কার করে। একটা বাচ্চা সহ সখিনার বিয়েটা হলো নুর ইসলামের সাথে, এখন ওরা ভাল আছে সুখে আছে।
কথাগুলো বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো অনিরূদ্ধ।
লাবনী পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনিরূদ্ধর দিকে। ওর আত্মতৃপ্তিতে ভরা মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগছিলো লাবনীর।
সখিনা তার ছেলে কাঠু আর সখিনার মা বাবাকে দেখেছে অনিরূদ্ধ আগেই। কারণ এই বিয়ের ব্যপারে আলাপ আলোচনা করার জন্য ওরা সবাই এসেছিল ওর ডাক্তার খানায়।
রামদয়ালকে সাথে করে বিয়ের দিন বিকালে পায়ে হেটে অনিরূদ্ধ গিয়েছিল সখিনার বিয়েতে। প্রায় এক ঘন্টার পথ।

বিদেশের মাটিতে জন্ম আর পশ্চিমা বিশ্বে লেখাপড়া করা অনিরূদ্ধর সেটা ছিল সম্পুর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রবাসী বাবার সন্তান অনিরুদ্ধ। ওর জন্মের দেশটা সব দিক দিয়ে এত পুরূষতান্ত্রিক যে ওর মা তার জন্মভূমির পরিচয়েও স্বামী সন্তানদেরকে ওর দেশের নাগরিক বানাতে পারিনি।
ওর মা আরবের অন্য দশটা মেয়ের মতই আরবী স্কুলে পড়াশোনা করে অতি রক্ষনশীল পরিবেশেই মানুষ হয়েছে। ওদেশের অন্য সব মেয়েদের মতোই ওর মাও কোন স্বামীর একাধিক স্ত্রীর একজন হওয়ার মানষিকতা নিয়েই বড় হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যে যা ছিল তায় হয়েছে।
অনিরুদ্ধর মা ওর বাবার একমাত্র স্ত্রী হওয়ার অনন্দটা উপভোগ করলেও ভিতরের মনটাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। আর তায় তিনি অনিরূদ্ধ আর অন্য আরো দুটো মেয়েকে সেদেশের প্রচলিত মানষিকতায় গড়ে তুলেছেন।
মা বাবা বা সমাজের অন্য কারো সাথে নিজের কোন একান্ত ভাবনা কখনোই খোলামেলা আলাপ করার কোন অবকাস ওদের ছিল না।
একটা ব্রিটিশ স্কুলে পড়তো অনিরূদ্ধ। স্কুলের পরিবেশ খোলামেলা হলেও সমাজের সব বাধা নিয়মের বেড়াজালেই ও বড় হয়েছে।
অনিরুদ্ধ যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখনই ওর ক্লাসের এক বান্ধবীর কাছ থেকে ওর নিজের সম্পর্কে একটা মন্তব্য ওকে হতচকিত করেছিল।
‘মেয়েদের সংস্পর্শ অনিরূদ্ধ ঠিক উপভোগ করে না।’
বান্ধবীর পর্যবেক্ষনটা ওর কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল। কিছু বলেনি সেদিন ও। ব্যাপারটা আলাপ করার মতো কাউকেই পেল না। তবে ধীরে ধীরে ও কিছুটা আত্মসচেতন হয়ে উঠাতে ব্যাপারটা ওর নিজের কাছেও অনুভূত হতে লাগলো।
কয়েক মাস পর পর ওদের স্কুলে সাইকোলজিক্যাল এ্যাডভাইজার আসতো। সবার সাথে কথা বলতো একত্রে অথবা একান্তে।
সাইকোলজিক্যাল এ্যাডভাইজার ছিলেন মধ্য বয়স পার হওয়া মাতৃহৃদয়া এক খৃষ্টান নান, নাম কারমেন মেরী। তার কাছেই একান্তে কথাটা বললো অনিরূদ্ধ।
কারমেন মেরী দরদ দিয়ে শুনলেন ওর কথা, বেশ কিছু প্রশ্নও করলেন। তারপর আদর করে ওকে কাছে নিয়ে বসে স্বস্নেহে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অনেক বড় বড় মনিষীদের জীবনী থেকে উদাহরণ দিয়ে অনেক কথা বললেন।
-এটা কোন রোগ বা শারীরিক সমস্যা নয়, এটা বলতে পার ঈশ্বরের এক ধরণের খেয়ালের প্রকাশ। এটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করবে না। মেনে নিয়ে মানিয়ে নিলে তুমি ঈশ্বরের বিশেষ আনুকল্য পাবে। তুমি যে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাও, আমার বিশ্বাস তোমার ও রকম মানবসেবাধর্মী পেশার জন্য এটা বরং অনুকুল হবে।
কারমেল মেরী একটু থেমে কিছু একটা ভাবলেন।
-এ সমস্ত দেশেও তোমার মত এমন অনেক মানুষ আছে কিন্তু অতিরক্ষনশীল সমাজ একটু ব্যতিক্রমকেও গ্রহন করতে চায় না, তায় ওদের প্রকাশের কোন অবকাস নেই। পাশ্চাত্য দেশে এটা খুব বড় কোন সমস্যা নয়। সেখানে যে যা, সে তায় হয়েও সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অতিরক্ষনশীল সমাজে না হয় সে বাস্তবতাকে ঢেকে রেখেই জীবনটা চালালে। এ অনেক বড় ত্যাগ আমি তা বুঝি।
কারমেন মেরী আদর করে অরিূদ্ধর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
-এটা ঈশ্বরের দান! ইশ্বরের ইচ্ছা মেনে নিয়ে পথ চললেই সেটায় পাথেয় হতে পারে। আর তাতেই যদি ইশ্বরের সন্তুষ্ট হয় হোক না, নিজেকে তাঁর কাছে পুরোপুরি সমর্পনের স্বাদ অনন্য।
কারমেন মেরীর কথাগুলো খুবই অতিইন্দ্রিয় মনে হয়েছিল অনিরদ্ধর সেদিন। এই বাস্তবতা যে ওর নিজের সাথে ঘটছে তা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছিলো না অনিরূন্ধ। সব কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হয়েছিল।
পরে লন্ডনে পড়াশোনা করার সময় বিষয়টা নিয়ে বেশ খোলাখুলি আলাপ করার অবকাস পেয়েছিল ও। বেশ কিছু সাথিও পেয়েছিল ওর মত। যাদের সাথে বিষয়টা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করার সুযোগ ছিল।
পড়াশোনা শেষ হলে অনেকবার ভেবেছে ওদেশে থেকেই জীবনটা পার করে দেবে। ওর ভিতরের যে বৈষম্য সেটা আগলা করেও বাচার মত পরিবেশ ওদেশে ছিল।
কিন্তু বাধ সাদলো দেখা যাওয়া বৈষম্য নিয়ে- যেগুলো লুকানো যায় না আর খোলা থাকলে এমনিতেই সবার চোখে পড়ে। সাদা চামড়ার দেশে চাক্ষুস সংখ্যালঘু হয়ে তৃতীয় শ্রেনীর মানুষের মত কিছু সময় হয়তো কাটানো যায় কিন্তু জীবন পার করা অসম্ভব বলে সেদিন মনে হয়েছিল অনিরুদ্ধর কাছে।

রজবালীর মেয়ের বিয়েতে পায়ে হেটে যাওয়ার সময় সেদিন পড়ন্ত বেলায় দিগন্তছোয়া খোলা প্রান্তরের মধ্য দিয়ে হাটতে হাটতে ওর ভিতরটা উল্টিয়ে রামদয়ালের মত একজন মানুষের কাছে বলতে পেরে ভারী ভাল লাগছিলো অনিরূদ্ধর।
- তায়তো সব ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছি মানুষের সেবার এই অভায়রন্যে, দেখি যদি জীবনের বাকি টুকু পার করা যায়।
বুক খালি করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে রামদয়ালকে কথগুলো বলেছিল সেদিন।

সেদিন হাতে তেমন কাজ ছিল না অনিরুদ্ধর। তাই ভাবল ওদের বিয়ের পর কেমন আছে ওরা তা দেখতে যাওয়ার। অনিরুদ্ধকে দেখলে ওরা খুশি হবে ওদের মনটা ভালো হবে সে উদ্দেশ্যেই রামদয়ালকে সাথে নিয়েই হাটছিল।
রামদয়ালের ব্যক্তিগত ব্যপারে কোনদিন খোজ নেয়নি অনিরূদ্ধ। আসার পর থেকে চিকিৎসা আর জমিদার অমর চৌধুরীর বিভিন্ন কর্মকান্ড বিশেষ করে হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।
এরই ফাকে ফাকে রামদয়ালের সাথে বিভিন্ন কাজের কথা বা অন্য মানুষ দের নিয়ে কথা হয়। হয় না কেবল ওর নিজের সম্মন্ধে কোন কথা।

তায় আজ হাটতে হাটতে অনিরূদ্ধ রামদয়ালকে জিজ্ঞেস করলো তার জীবন সম্পর্কে।
-আমার স্যার একটায় গল্প। আর তার সবটুকুই এই চৌধুরী এষ্টেটকে ঘিরেই। পরদাদাকে আসগর চৌধুরী এনেছিলেন। তিনি ছিলেন সংসার বিরাগী আয়ুর্বেদ। শেকড় বাকড় নিয়েই ওর দিন কাটতো। আসগর চৌধুরী ওর শেকড়টা একটু পাকা পোক্ত করে গাড়ার জন্যই জাত পাট মিলাতে যেয়ে একদম হিমশিম খেয়েছিলেন। শেষে জাতপাটহীন এক অভাগীনির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। তারপর থেকেই বোধহয় শেকড়টা গেড়ে গেল এ তল্লাটে।
-ওসব অনেক দিনের কথা। বাবার একটা বোন ছিল, দূর এক গায়ে বিয়ে হয়েছিল। খোজ নিতে পারিনি কখনো। আমি বাবার একই ছেলে। ছোট থাকতেই মা বাবা দুজনাই আমাকে রেখে চলে গেল।

দুজনেই চুপচাপ, হাটতে লাগলো পাশাপাশি। পশ্চিম আকাশে সুর্য্যটা ডুব দেয়ার আগে গাছের ডালের ফাক দিয়ে উকি দিয়ে দিয়ে দেখে নিচ্ছে।
-তা সংসার করছো না কেন?
একটু হাসলো রামদয়াল।
-স্যার, ইশ্বরের ইচ্ছে মেনে নিয়ে পথ চললেই সেটায় পাথেয় হতে পারে। আর তাতেই যদি ইশ্বরের সন্তষ্টি হয় হোক না।
কথাটা শুনতেই দাঁড়িয়ে গেল অনিরূদ্ধ। সরাসরি তাকালো ওর চোখে।
-তারপর! তারপর কি হবে? এখানেই তো সব শেষ না।
অনেকটা চাপা কন্ঠে কথাটা বলল অনিরুদ্ধ।
-বাপ দাদার যা হয়েছে তায়। চৌধুরী এষ্টেটের সাথে মিশে থাকবো।
রামদয়ালের জবাবটা অবোধ্য লাগলো অনিরদ্ধর কাছে।
মৃদু হাসলো রামদয়াল।
-বাবা যেমনি ঠাকুদার ভস্ম ছড়িয়ে দিয়েছে চৌধুরী এষ্টেটের কোণে কোণে আমিও তেমনি বাবার ভস্ম একটু একটু করে ছড়িয়ে দিচ্ছি চৌধুরী এষ্টেটের মাটিতে। আমিও একদিন এই খাঁচা থেকে বেরিয়ে মিসে যাব এই মাটির সাথে।
কথাটা বলে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়লো রামদয়াল।