জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'কেঁচো'।

আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:৪৩

কেঁচো


বেশ কয়েক দিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে তবে যেন মন খুলে নয়। আষাঢ়ের মত বড় বড় ফোটাও পড়ছে, আবার মাঝে মাঝে শ্রাবনের ইলশে গুড়িও ঝরছে।
দুটোই আছে কিন্তু কোনটাই পুরোপুরি না।

সারা জীবন ধরে চাকরি করে অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে করতে জীবন কাটিয়েছি। তাইতো নিজের মত করে কোন কিছুই করতে পারিনি। অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার দেখানো পথে হেটেছি। পথটা আমার না কিন্তু বুদ্ধিটা আমার, অন্যের দেয়া পথে হাটার জন্য বের করে নিয়েছি। বলা বাহুল্য সে জন্যই মালিক পক্ষ আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।
অন্যের দেখানো পথে তার বোঝা বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজের বুদ্ধি দিয়ে হেটেছি। মালিকের বোঝা মাথায় নিয়ে তার দেয়া গন্তব্যে পৌঁছানোর সে হাটা হাটিতে কোন কোন সময় আমি ছিলাম আবার কোন কোন সময় ছিলাম না, ছিলাম অন্যমনস্ক হয়ে অন্য দুনিয়াই।
অনেকটা এই আশ্বিনে, আষাঢ় আর শ্রাবন মাসের মিশ্রিত বৃষ্টির মত। দুটোর কোনটায় নেই আবার বর্তমানটাও নেই।
আশ্বিনের এই মাঝামাঝি সময়ে মেহেরকুঞ্জের উঁচু বারান্দায় বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জীবনের সে সব কথায় ভাবছিলাম।

প্রকৃতি যেন তার বইয়ের পাতা ইচ্ছে মত পিছন দিকে উল্টে দিয়ে নিজ ইচ্ছেই চলছে। এখন কোন কিছুই যেন সময় অনুযায়ী ঘটে না। সময় অনুযায়ী, মানে বইয়ে লেখা সময়ের কথা বলছি। আষাঢ় শ্রাবন মাসে যে বৃষ্টি হয়ার কথা আশ্বিনে সে রকম বৃষ্টি হচ্ছে তবে সেটা আবার দুটো মিশিয়ে। মাসটা তার আলাদা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে আষাঢ় শ্রাবনের মিশ্রণ হয়ে উঠেছে।

মাসের শুরু থেকে আকাশটা একই রকম ভাবে সব সময়ে মুখ ভার করে আছে। সূর্য হাসছে না, দাত বের করেও না আবার মুচকিও না।

প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের বোধকরি একটা যোগাযোগ আছে। মেহেরকুঞ্জে আসার পর থেকে আমিও কেন জানি মন খুলে কিছু করতে পারছি না। আমারও চিন্তা চেতনা যেন আষাঢ় আর শ্রাবনের মিশ্রণের মত হয়ে গেছে।
এবার আমার মেহেরকুঞ্জে আসা অন্য যে কোন সময়ে আসার থেকে একেবারে আলাদা। যত খুশী, যতদিন খুশী বুক ভরে নিঃশ্বাস নেব বলে এবার এসেছি এই প্রকৃতির মাঝে।
মেহেরকুঞ্জ আমার পিতৃ পুরুষের ভিটায় মনের মাধুরী মিশিয়ে চারদিকে উঁচু খোলা বারান্দার উপর তৈরি আমার বাড়ীটা। শত কাজের চাপে ক্লান্তি ভুলতে এখানে মাঝে মধ্যে এসে দু চার দিন থেকে যায়।
এ যবত যখনি এসেছি, ফিরে যাওয়ার দিন ক্ষনের দিকে নজর রেখে এখানে সময়টা কাটিয়েছি। এখানে থাকার দিন গুলোতে সব সময় ফেরার একটা অদেখা চাপ থাকতো মাথার ভিতর।
কিন্তু এবার সেরকম না, একদম অন্যকোন বারের মত না। এবার এসেছি ফেরার দিন ক্ষণ ঠিক না করেই। ফেরার কোন তাড়া নেই। এসেছি প্রকৃতির সবুজের মাঝে দাঁড়ানো মেহেরকুঞ্জের সাথে মিশে একাকার হয়ে আমার বাল্য স্মৃতির সরোবরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাব বলে।
নির্জনতায় হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে কি তৃপ্তি সেটা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যারা হারিয়েছে তারা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সেটা হয়ত কল্পনা করা যেতে পারে, তবে তার সে স্বাদ নেয়া সম্ভব না।

নির্জনতার একটা আলো আছে যেটা সবার চোখে পড়ে না। অনেকটা রাতের আধারের ভিতর ইনফ্রারেড ক্যামেরার চোখে যেমন সব সব ধরা পড়ে, অনেকটা সেরকম কিছু।
মেহেরকুঞ্জের খোলা বারান্দায় নির্জন নিস্তব্দ অন্ধকারে বসে নিজেকে হারিয়ে হারানো স্মৃতি গুলোর আলোর বিচ্ছুরণের সরোবরে আমি ডুব সাতার খেলছি ইচ্ছে মত। বাল্যের স্মৃতিগুলো এক এক করে ভেসে উঠছে। অন্য কেউ দেখতে না পেলেও আমি তা পরিষ্কার দেখতে পারছি।
মানুষের স্মৃতি বা স্বপ্ন মরে না, সময়ের ফেরে বা কাজের ভিড়ে পিছনের কাতারে লুকিয়ে থাকে। তাইতো কাজের ফাকে ফাকে বিভিন্ন ঘটনার অসিলায় সেগুলো পিছনের সারি থেকে আড়ামোড়া ভেঙ্গে সামনে চলে আসে।
আর এখন তো আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি সেগুলোকে সামনের সারিতে আনবো বলে।
হারানোর তৃপ্তিতে নিমগ্ন হয়ে আত্মসুখে নিরত হয়ে থাকি।

কৃষ্ণ কালো রাত। আমি বেসে একা, একদম একা। বৃষ্টির একটানা শব্দ সমুদ্রে ডুবে মেহেরকুঞ্জের বারান্দায় চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে স্মৃতির লুকোচুরি উপভোগ করছি।
সামনে আর চারপাশ সব মিলে মিশে একাকার। কোন কিছুর থেকে কোন কিছুর যেন কোন পার্থক্য নেই। জানি সব আছে কিন্তু নেই বললেও বোকা মন তেমন আপত্তি করবে না।
চোখ খুলে রাখলেও যা, বন্দ রাখলেও তা। সে কারণে অন্য সব ইন্দ্রিয়গুলো অতি সজাগ।

হটাৎ বারান্দার উপর একটা ঈষৎ আলোর রেখার দিকে নজর পড়ায় যেন আমার ধ্যান ভঙ্গ হল। এক অজানা আশঙ্কায় আমার শরীর নিজের থেকেই সতর্ক হয়ে উঠল।
শরীরের আলাদা বুদ্ধি আছে, যা স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করে। কিন্তু মনের বুদ্ধি যখন শারীরিক বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তখন ঘটমান পরিস্থিতিকে অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করে।
প্রথম ধাক্কাটা সামলানোর পর বুঝলাম ওটা ভয়ের বা ক্ষতিকারক কিছু না, একটা কেঁচো, বর্ষার পানিতে ওর নিজের বাসাটা ডুবে যাওয়াই তা ছেড়ে আমার বাসায় উঠে এসেছে।
আগে কোথাও বোধহয় পড়েছিলাম, কেঁচো তাদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরণ করতে পারে। সেটা এই প্রথম নিজ চোখে দেখলাম।
অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখতে হলে বাইরে থেকে তার উপর আলো ফেলতে হয়, তখন সে বস্তু বা জীবটি বাইরের আলোতে আলোকিত হয়ে অন্যের চোখে ধরা দেয়। বাইরের আলোতে সেগুলোর বাইরেটা দিনের আলোতে যে ভাবে দেখা যায় সে ভাবেই চোখে পড়ে, আলাদা কিছু না।
কিন্তু কোন কিছুর দেহের ভিতর থেকে যখন একটা আলোর তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়, সে আলোর বিচ্ছুরণ নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
চারদিকে অন্ধকার পরিবেশে কোন ঘরের ভিতর থেকে বিচ্ছুরিত আলোর অপরুপ সৌন্দর্য দেখতে বাইরের কোন আলোর দরকার হয় না। বাইরের অন্ধকার যত গাড় হয় ভিতর থেকে বিচ্ছুরিত আলোটা ততো স্বপ্নিল লাগে।

কেঁচো দেখলে অনেকের গাঁ ঘিনঘিন করে, আমিও সেই অনেকের দলে। কিন্তু এই অন্ধকারের নির্জনতার মধ্যে একটা কেঁচোর দেহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো যে অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারনা করে সে অনুভব আগে আমার জানা ছিল না।
কেঁচোটাকে ভাল ভাবে দেখার জন্য চেয়ার থেকে নেমে খুব ঘন হয়ে বসলাম।
ওদের চলার গতি খুবই স্লথ, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও ঠিক বুঝলাম না সে ঠিক চলছে কিনা? কেঁচোর চোখ থাকে না, ওদের চোখের দরকার হয় না, ওরা ওদের চামড়া দিয়ে দেখার সে কাজগুলো সেরে নেয়।

কেঁচোরা মাটির কয়েক ফুট গভীরে বাধে বাসা বাধে। সেখান থেকে মাটি গিলে তা প্রক্রিয়া করে উপরে পাঠায় সার হিসেবে। মাটির নিচে কর্মব্যস্ততার মধ্যে ওরা ওদের চামড়া দিয়েই নিঃশ্বাস নেয়ার কাজটা সেরে নেয়। কিন্তু এখন অবিরাম ঝরতে থাকা বৃষ্টির পানিতে ওদের বাসাগুলো প্লাবিত হওয়াই কেঁচোটা তার বাসস্থান ছেড়ে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য উপরে উঠে এসে আমার বাসার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে।
কথাটা ভাবতেই এই অতি নগন্য এই অমেরুদণ্ডী প্রাণীটির প্রতি আমি এক ধরনের বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করলাম।
শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠির দুই প্রান্তের বাসিন্দা আমরা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা একই কারনে এই মুহূর্তে অন্ধকারে নিমজ্জিত একই বারান্দায় বসে আছি।
আমি দম আটকানো ইট পাথরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মুক্ত ভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এই প্রকৃতির অরন্যে এসেছি। আর কেঁচোটাও মাটির নিচে তার বাসায় নিঃশ্বাস নিতে না পেরে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেবে বলে এখানে এসেছে।
আমরা দুই মেরুর বাসিন্দা হয়েও আমাদের এখানে আসার প্রয়োজনটা এখন অভিন্ন।
কিন্তু আমাদের জীবনের লক্ষ্যটা কতটা ভিন্ন!
এই নগন্য প্রাণীটির জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মাটি খেয়ে সেটা প্রক্রিয়া করে মাটিকে উর্বরতা দান করা। দেয়ার জন্যই তার জন্ম আর সেটাই তার জীবনের উদ্দেশ্য।
আমি প্রকৃতই জীবনের কাছ থেকে নিতে নিতে রেশমি পোকার মত আমার চারধারে আমার অর্জনের দেয়াল গড়ে তুলে বের হওয়ার রাস্তাটাও বন্দ করে দিয়েছিলাম। তাই, ক্লান্ত হয়ে সে দম আটকানো পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এখানে এসেছি।
এই নগন্য জীবটি নিজেকে অপরের জন্য উৎসর্গ করেই জীবন অতিবাহিত করছে। তাইতো সে সব মায়া মুক্ত, কোন পিছু টান নেই ওর। মায়াই সব দুঃখের মূল। সে তার সব কিছু অন্যকে দিয়েই সে মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়েছে।
যারা দিয়ে নয় নিয়ে জীবনকে সার্থক মনে করে তাদের সকলকে তাদের সংসার, সম্পদ এগুলোর মায়ার পিছে টানে আটকে থাকে।
নেয়াতে ক্লান্তি আছে, হারানোর ভয় আছে। কিন্তু দেয়াতে কেবলই প্রশান্তি। নেয়াটা ব্যয় কিন্তু দেয়াটা প্রকৃতই আয়।

চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেল। ভোরের সূর্যালোক মুখের উপর পড়াতে হারানো জগত থেকে বেরিয়ে আসলাম।
বৃষ্টি থেমে গিয়ে শরতের আকাশ তার নিজ রুপ ফিরে পেয়েছে। চারিদিক থেকে বৃষ্টির পানি নেমে যেতে শুরু করেছে।
দেখলাম কেঁচোটা নেই। সারা রাত ধরে বুকে হেটে হেটে কোথাও হয়তো নিরাপদে পৌঁছে গেছে। সে নিশ্চয় আবার নতুন কোন বাসা বেধে নিয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
ভাবলাম, আহ কেঁচোর মত সবার জীবন যদি দেয়ার জন্য উৎসর্গ কৃত হত! তাহলে এই পৃথিবীতেই স্বর্গ গড়ে উঠত।