জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'ঘুটঘুটে অন্ধকারে কুচকুচে কালো বিড়াল খোজা'।।।

আপডেট: ০৮ Jun ২০২৩, ১৩:২৪

ঘুটঘুটে অন্ধকারে কুচকুচে কালো বিড়াল খোঁজা

 

সেদিন খুব ভোরে স্টেশানে যে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটাতেই উঠে বসল অবনী। উঠতেই ট্রেনটা যাত্রা শুরু করল। যেন ট্রেনটা ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দুধারের রংবেররং দৃশ্য দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। কত স্টেশানে ট্রেনটা থামল, কত মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে নামলো আবার কত নতুন নতুন মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠলো।

ট্রেন যাত্রার অন্য রকম একটা বৈশিষ্ট্য আছে। ট্রেনটা কারো ইচ্ছেই নয় বরং নিজ ইচ্ছেই কেবল পূর্ব নির্ধারিত স্টেশানে থামে, যেটা আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা থাকে। তবে হ্যে, দুর্ঘটনার ব্যপারটা ভিন্ন, সে ব্যপারে যাত্রীদের তো নয়ই, ট্রেনেরও কোন হাত থাকে না।
অবনীর নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই, তাই চলাতেই ওর যত আনন্দ।

কিন্তু বাদ সাধল টিকিট কালেক্টর। টিকিট না থাকার অপরাধে ওকে এক অজানা স্টেশানে নামিয়ে দিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলল তার গন্তব্যে।
জায়গাটা একদম অচেনা অবনীর। ভালই হল, চিরকাল মেনে নিয়ে মানিয়ে নিতে বিশ্বাসী সে।
অজানা গন্তব্যে ভ্রমনের ব্যাপারটা অবনীকে চিরকাল খুব টানে। আর সেটা যদি অচেনা জায়গাই হয় তাহলেতো কথাই নেই।
অচেনা যায়গায় অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমন! মন সারাক্ষণ রোমাঞ্চে ভরে থাকে।
আর চেনা যায়গায় অজানা গন্তব্যে ভ্রমন হলে, অজানা গন্তব্য মনটাকে রোমাঞ্চিত করে রাখলেও চেনা পারিপার্শ্বিকতার স্মৃতি মনকে প্রায়শই পিছু টেনে উদাস করে রাখে।
নিজের সব চেনাজানা মুখের কাছ থেকে হারিয়ে ধারে কাছে কোথাও লুকিয়ে থাকলে যেমন আপনজনদের ভালবাসার স্বরূপটা আঁচ করা যায়, তেমনি নিজের কাছ থেকে হারাতে পারলে নিজেকে প্রকৃতই উপলব্ধি করা যায়।
শরীরের মৌলিক চাহিদা; অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থান, সেটা প্রাকৃতিক নিয়মে কোন না কোন ভাবে জোগাড় হয়ে যায়। খাদ্য সংগ্রহ করে খেয়ে বেচে থাকাই যখন আদিম মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সে যুগে মানুষ প্রকৃতি আর পারিপার্শ্বিকতা থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে যুগ যুগ ধরে বেচে থেকেছে। সে চিন্তা থেকেই, শারীরিক মৌলিক চাহিদা পুরনের ভাবনাটা অবনীকে কখনো তেমন ভাবে বিচলিত করে না।

পাহাড় ঘেরা জংলা জায়গা, একদম অচেনা। তাই গন্তব্যের কোন প্রশ্নই ওঠে না।
ছোট একটা স্টেশান। ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর পরই প্লাটফর্মটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।
লাল টিনের ছাউনির নিচে লাল দেয়ালের ছোট্ট স্টেশান।
প্লাটফর্মের অদূরে খালি একটা সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চের উপর বসলো অবনী।
সামনে লাইনের ওধারে কিছুটা উঁচু নিচু খালি জায়গার পর সুউচ্চ পাহাড়ের সারির পিছনে সূর্যটা লুকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাহাড়ের ছায়াটা ধীরে ধীরে হালকা থেকে গাঢ় হয়ে অন্ধকার জায়গাটা গিলে ফেলার তোড়জোড় শুরু করছে।
কিছুক্ষণ আগেও সূর্য কিরণ ওর চোখে মুখে লাগছিল। পাহাড়ের ছায়া হালকা থেকে ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে অন্দকারে পরিণত হওয়ার এ অপরুপ দৃশ্যটা ইতিপূর্বে কখনো খেয়াল করিনি অবনী। তাই খুব গভীর ভাবে সেটা অবলোকনের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল সে।

খুক খুক করে কাসির শব্দে ওর যেন ধ্যান ভঙ্গ হল।
কান মাথা শরীর সব চাদরে জড়িয়ে শুধু চোখ আর নাকটা বের করে কাছেই দাঁড়ানো একজন মানুষ। খাকি লিভারি পরনে, হাতে একটা হ্যারিকেন।
-এই শীতের মধ্যে তুমি এখানে বসে? আজতো আর কোন ট্রেন আসবে না।
ছ ফুটের মত লম্বা ছিপছিপে শরীরে গর্তে বসানো চোয়াল দুটোর মাঝখানে নম্বা নাকে দাঁড়িয়ে থাকা সিগন্যালম্যানকে ভালই লাগলো অবনীর।
চাদর দিয়ে পুরোপুরি আবৃত শরীরের বয়সটা আঁচ করতে গেলে ভীষণ ভুল হতে পারে। তবে অবনীর থেকে বয়সে অনেক বড় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
-তাতে আমার কিছু আসে যায় না, আমিতো কোন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি না।
খুব শান্ত স্বরে উত্তর দিল অবনী।
-রাতটা কাটার পরেইতো সকাল হবে, সূর্য উঠবে। শীত শেষ হয়ে গেলেও এখনো এখানে ঠান্ডা আছে, একটু পরেই পাহাড় থেকে কনকনে শীতের বাতাসের ঝাপটা আসতে শুরু করবে। তাই বলছি এখানে এভাবে বসে না থেকে আমার সাথে চল।
লোকটা অবনীকে চেনে না জানে না তার পরও কেমন আপন জনের মত ওকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য ডাকছে!
-কই চল। এখানে এই আলো টুকুই সম্বল, অন্ধকারে এখানে নিজেকেও দেখা যায় না। তখন চোখ বুজলেও যা খুললেও তা।
অবনী বিনা বাক্যে সিগন্যালম্যানকে অনুসরণ করে চলল।

দুধারে পাহাড়ের সারির মাঝে ছোট একটা উপত্যকায় নির্মিত স্টেশানটা। স্টেশানের পিছন দিকেই একই সমতলে উচু মেঝের উপর নির্মিত পাশাপাশি লাগোয়ে বেশ কয়েকটা রেলের কোয়াটার। সামনে এক চিলতে খোলা বারান্দার সাথে পশ্চিম মুখী প্রতিটি ঘর। সব গুলোই অন্ধকার, কেউ থাকে বলে মনে হয় না। সব গুলো ঘর পেরিয়ে একদম শেষের অর্থাৎ উত্তর দিকের ঘরের বারান্দায় সিগন্যালম্যান অবনীকে সাথে নিয়ে উঠলো।
সামনের দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকল ওরা। ভিতরে একটা বিছানা পাতা ডবল খাট আর পাশে দেয়ালের সাথে বুক অব্দি উঁচু দুই কপাটের কাঠের একটা আলমারি, ছোট একটা কাঠের টেবিল আর দুটো কাঠের চেয়ার।
টেবিলের উপর হ্যারিকেনটা রেখে অবনীকে ঈশারাই চেয়ারে বসতে বলে পিছনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সিগন্যালম্যান।

পেছনের দরজাটা খুলতেই নিষ্প্রভ আলোর ঝলক এসে পড়ল ঘরটার ভিতর।
একটু ইতস্তত করে অবনী দরজা দিয়ে উঁকি দিল পিছনটা দেখার জন্য। বেশ ঢালু আর বেশ নিচে কয়েকটা আলোকোজ্জ্বল বেড়ার ঘর। বাশের তরজার বেড়ার প্রতিটি সরু ছিদ্র দিয়ে ভিতরের আলো উঁকি দিয়ে যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছে।
বাইরে থেকে আলো ভেতরে ঢুকলে ভেতরটা দেখা যায় তবে শুধু যেটুকুর উপর আলো পড়ে সেটুকুই। আলোর চারপাশটা অন্ধকার থাকে অনেকটা আলো আধারির লুকোচুরির মত ব্যপার হয়। কিন্তু ভিতর থেকে আলোকচ্ছটা বের হলে সেটা যে কতটা মোহনীয় হয়ে ওঠে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
বেড়ার ফাঁক আর খোলা দরজা জানালা দিয়ে ঘর গুলোর ভিতরে গুটিকতক মানুষের আবছা পদচারনা চোখে পড়ছে।
সিগন্যালম্যানের রুমের সামনেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাকা দেয়ালের রুমের ভিতরে হেরিকেনের অপ্রতিভ আলো একধরণের রাত কানা ভাবের সৃষ্টি করেছে।
-ওরা কি সিগন্যালম্যানের পরিবারের সদস্য, পিছন দিকটাতে বসবাস করে!
উৎসুক হয়ে উঠলো অবনী।
পিছনে ঢালুতে নামার পাচটা পাকা সিঁড়ি, সেগুলো ভেঙ্গে নিচে নেমে আলোক বিচ্ছুরনরত শত ছিদ্র বেড়ার ঘরগুলো দেখার বাসনা অবনীকে তাড়া করতে লাগলো।
সামনে নিচে আলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সিড়ি পাচটা নামল অবনী। কিন্তু না, ভিতর থেকে আলোক বিচ্ছুরনরত বেড়ার ঘরগুলো উপর থেকে যতটা নিকটে মনে হচ্ছিলো দূরত্বটা তার থেকে ঢের বেশী। আরো বেশ কিছুটা পথ নামতে হবে। তবে তার জন্য আর কোন সিড়ি নেই।
বেশ দ্বিধান্বিত অবনী। কিন্তু সামনে আলোক বিচ্ছুরণরত শতছিন্ন বেড়ার ঘরগুলো ওকে দারুন ভাবে আকর্ষণ করল। সে টান অগ্রাহ্য করতে পারল না অবনী।
সামনে দৃষ্টি রেখে অবনী পাকা সিড়ির নিচে পা রাখতেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিছলাতে পিছলাতে নিচ অব্দি চলে গেল। মনে হল পিছন থেকে কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে ওকে নামতে সাহায্য করল।
নিজেকে সামলে নিতেই চোখে পড়ল সামনে একটা খোলা দরজা।
ভিতরে আলো জ্বলছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কাউকে।
একটু বাদেই পাশের কোথাও থেকে একজন ঢুকল। চেনা লাগলো, এখানে একজনকেই চেনে অবনী, মনে হল সিগন্যালম্যান। কিন্তু তার গায়ে পেচানো চাদরটা নেই। সন্ধ্যার সময় চাদর পেঁচানো থাকায় তাকে ভাল ভাবে দেখতে না পেলেও এবার ভাল ভাবে দেখে নিল অবনী।
শীতে জড়সড় নিজেকে গুটিয়ে নেয়া সেই মানুষটা যেন ওর দেহ থেকে বিদায় নিয়েছে। এমনিতেই দেহে অতিরিক্ত কোন মেদ মাংস নেই, শরীরে কোন ক্লান্তি আছে বলে মনে হল না। দেহের বয়স কমে একদম ঝরঝরে এক যুবক মনে হল তাকে।
খুশীতে শরীর মন যেন ডগমগ করছে। বেড়ার ঘরটার মত এই মানুষটির ভিতর থেকেও যেন আনন্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। শরীর মন খুশীতে ডুবে থাকলে কাউকে যে এত সুন্দর দেখায় তা অবনীর জানা ছিল না।
রেল কর্তৃপক্ষের বরাদ্দকৃত ইট সিমেন্টের তৈরি অন্ধকারাচ্ছন্ন কোয়াটারের পিছনে প্রকৃতির কোলে তৈরি শতছিদ্র বেড়ার ঘর আর এই মানুষটার ভিতর থেকে যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। তা দেখতে হলে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন শক্ত আবরণ ছেড়ে পাচ সিঁড়ি নেমে এই প্রকৃতির কোলে আসতে হবে।

-বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? এতটা যখন এসেছ তখন ভেতরে প্রবেশ কর।
তার কথাই মন্ত্রমুগ্ধের মত ভিতরে প্রবেশ করতেই অনুভূত হল এক অদেখা তরঙ্গমালা অবনীকে যেন ঘিরে ফেললো।
-সবাই সারাদিন জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত থেকে সন্ধ্যা নামলে আসে এখানে। এরা সব রাস্তা থেকে আসা মানুষ। কবে কার কোথায় শুরু হয়েছিল তা সঠিক ভাবে কেউ জানে না, আর কবে কে কি ভাবে শেষ হবে তা নিয়েও কারো কোন চিন্তা নেই।
-সারাদিন ধরে জীবিকা অর্জনে কাজ শেষ করে সবাই এখানে আসে জীবনের সন্ধানে।
অবনী তাকাল তার চোখে।
-জীবিকার জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান প্রয়োজন অনস্বীকার্য কিন্তু জীবনের জন্য দরকার প্রশান্তি, দেহ মনে নয়, হৃদয়ে।
অবনীর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে সে বলল- চল তোমাকে জীবনের অন্বেষণ দেখায়।
তার ইশারাই ঘর গুলোর পিছনে আরো কিছুটা নেমে একটা খোলা জায়গায় এসে দাড়াল তারা। ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিকটের মানুষের শারীরিক আকারটা মোটামুটি বোঝা যায় কিন্তু চেনার কোন উপায় নেই।
অবনী অনুভব করলো বেশ কিছু মানুষ এই খোলা জায়গায় চলাফেরা করছে।

-এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সবাই এরা একটা করে কুচকুচে কালো বিড়াল খুঁজছে। ওরা জানে সবার জন্য আলাদা আলাদা বিড়াল বরাদ্দ আছে আর একজনের জন্য নির্ধারিত বিড়াল অন্য জন নিতে পারবে না। কিন্তু নিজ বিড়ালটা কেবলমাত্র সেই ধরতে পারবে, যে তা খুঁজতে যেয়ে অন্য কাউকে একটুও কষ্ট দেবে না বরং অন্যকে তারটা খুঁজতে সাহায্য করবে।
অবনী অবাক হয়ে তাকিয়ে মানুষটির উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।
-ভাবছো অন্ধকারে কালো বিড়াল খুঁজতে গেলে একে অপরের সাথে ধাক্কা ধাক্কি হবে। হ্যে, সেটা অবধারিত। সবাই যখন কালো বিড়াল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে একজনের সাথে অন্য জনের ধাক্কা লাগবে সেটাই স্বাভাবিক।
-জীবিকা অন্বেষণকারীদের মধ্যেও এমনটিই ঘটে। কিন্তু তাদের মধ্যে ধাক্কা লাগলে তারা জীবিকার দৌড় প্রতিযোগিতায় একে অপরকে মাড়িয়ে চলে যায়। তাদের দেহ মন সব সময় অতৃপ্ততায় ভরে থাকে। কিন্তু জীবনের সন্ধানরত মানুষের বিশ্বাসটা ওদের মত ঠুনকো না, কারণ তারা জানে তাদের বিড়ালটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। তাইতো তাদের মধ্যে কোন শত্রুতা বা হিংসা থাকে না, প্রতিযোগিতাও থাকে না। এখানে সবার হৃদয় অন্যকে সাহায্য করার প্রশান্তিতে ভরা।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তে অবনী শুনতে লাগলো সব কথা।
-অপরকে উপকারের মধ্যেই কেবল নির্মল শান্তি নিহিত। সেটাই সব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। আমারা সবাই লক্ষ্যভ্রষ্ট। তাইতো এত অবিশ্বাস, পরশ্রীকাতরতা, আর হানাহানি।
অবনী অনুধাবন করল, প্রকৃতই সেও তার কালো বিড়ালটা খুঁজে ফিরেছে।