প্রতিশোধ

আপডেট: ২১ Jun ২০২২, ১৪:৩৯

প্রতিশোধ

 

গত প্রায় এক যুগেরও বেশী কাল যাবত দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বিদেশে বসবাস করছে জীবন। বছরে অন্তত একবার করে দেশে আসার চেষ্টা করে। তখন দেশের সব সহায় সম্পত্তি দেখাশোনা করে যাবতীয় কাগজ পত্রের কাজ সহ বাড়ী ঘর দুয়োরের কোন ছোট খাট মেরামতের কাজ থাকলে সে গুলো শেষ করতেই সময় ফুরিয়ে যায়।
ছেলে মেয়েদের বিদেশে প্রতিষ্ঠা করে শেষ বয়সে দেশে ফিরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা আছে ওর। সমাজের মানুষের জন্য কিছু করা আর নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন কাটানোর জন্য দেশে ফিরে একটা ইন্ডাস্ট্রি করার পরিকল্পনা ওর দীর্ঘদিনের।
বিদেশে বিভিন্ন রকম কাজ শেষ করে এবার প্রায় বছর দুই পর দেশে ফিরল অবনী। ইচ্ছে আছে এবার লম্বা সময়ের জন্য দেশে থেকে ইন্ডাস্ট্রির কাজে হাত দেবে।
এরই মধ্যে ইন্ডাস্ট্রির জন্য ক্রয় করা প্রায় দশ একর জমির জরিপ হয়েছে আর ওর পক্ষে কেউ দলিল উপস্থাপন না করার ফলে সে জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে।
ব্যাপারটা জেনে বেশ আহত হল জীবন। বড় ধরনের একটা সমস্যা কিন্তু অসমাধান যোগ্য নয়। কোর্ট কাচারি করতে হবে। টাকা পয়সা খরচ বাদেও সময়ের ব্যাপার।
ওর কাছের বন্ধুরা সবাই খুব আফসোচ করে সমবেদনা জানালো।
কিন্তু মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হল যখন জানলো যে ওর একই বয়সি অতি পরিচিত অধীর যার মাধ্যমে বলা চলে জমি খন্ড কিনেছিল তার অসহযোগিতার ফলে এ কাজটা হয়েছে।
অধীরের সাথে নিয়মিত টেলিফোনে কথাবার্তা হয় জীবনের। ওর জমির সাথে লাগোয়া জমি তাই অধীরই বর্গা চাষির কাছ থেকে টাকা আদায় করে জীবনের একাউন্টে জমা দেয়ার কাজটা করে বরাবর।
কৃষি কাজ করে অধীর। দুটো মেয়ের পর ওর ছেলেটা গত কয়েক বছর হল ম্যাট্রিক পাশ করে বাড়ীতেই বসে আছে। মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিতে জমানো টাকা বলতে গেলে শেষ, তাই ছেলেটার একটা চাকরীর খুব দরকার। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ভাল কোন চাকরী যোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে অধীর জীবনকে অনুরোধ করেছিল ছেলেটাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করার। আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করার আশ্বাসে জীবন অধীরের কাছ থেকে ওর ছেলের কাগজপত্রও দিয়েছিল।
কিন্তু ওর ছেলের কোন ব্যবস্থা করার আগেই জীবনের দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনার কথা জেনে অধীর ওর ছেলেকে বিদেশে না পাঠানোর জন্য জীবনকে মনে মনে দায়ী করে অভিমানে ওর সাথে যোগাযোগ বন্দ করে দেয়। আর তাই জরিপের সময় অধীর বিষয়টা জীবনের কাছে গোপন রাখার ফলে জমিটা মূল মালিকদের শরিকদের নামে রেকর্ড হয়ে যায়।
কারো উপকার করা মনুষ্যত্বের কাজ তবে কোন ভাবেই সেটা দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে না। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় কিন্তু উপকার না করার কারণে কাউকে শাস্তি দিলে বা তার ক্ষতি করাটা নিতান্তই অপরাধ।
বিষয়টি দারুন ভাবে আহত করল জীবনকে।
যাহোক, জমিটা তার নামে ফেরত পাওয়ার জন্য জীবন যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করল।
পাশা পাশি যে ব্যাপারটি ঘটলো তা হল, কিছু মানুষের বুদ্ধি পরামর্শে জীবন তার এককালের হিতাকাঙ্ক্ষী অধীরকে সমস্যাই ফেলে প্রতিশোধ নেয়ার মনস্ত করল।

দেশে ফিরে জরিপের বিষয়টা জানার পর জীবন অধীরের কাছে অভিযোগ ও আফসোচ প্রকাশ করেছিল। অধীর খোড়া যুক্তি হিসেবে ওর বিভিন্ন ব্যস্ততা আর পারিবারিক সমস্যার কথা জানিয়েছিল। তারপর থেকে একটা অপরাধ বোধে ভুগে অধীর জীবনের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকে ওকে এড়িয়ে চলতে লাগলো।
বিদেশে চাররীর চাহিদা অনুযায়ী অধীরের ছেলের বয়সটা একটু বেশী থাকাই জীবনকে জানিয়েই অধীর ওর ছেলের ম্যট্রিক সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখটা ট্যাম্পার করে জীবনকে দিয়েছিল। বন্ধুদের সলা পরামর্শে জীবন সেটাকেই পুঁজি করে সার্টিফিকেট জাল করার অপরাধে অন্য একজনকে দিয়ে অধীরের ছেলের নামে একটা জালিয়াতি কেস রজ্জু করলো।
ঠান্ডা থেকে লড়াইটা উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।
কিছু দিনের মধ্যেই বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল। অধীর সহ অন্যান্য কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে জীবনই এ কাজটা করিয়েছে।
জীবন প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। রাজধানী শহরে প্রাসাদ তুল্য বাড়িতে বসবাস করে। এলাকায় নামডাক আছে। অন্য দিকে অধীর কোনরকমে দিন কাটানো একজন কৃষক। জীবনের জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এলাকার সবাই তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে অধীরের অসহযোগিতার জন্য তাকে কঠোর ভাবে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু সেই এলাকাবাসীই এখন সমস্বরে জীবনের সমালোচনায় মুখোর হয়ে উঠলো। জীবনের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে কোন রকমে জীবন কাটাচ্ছে সেই অধীরকে এরকম একটা বিপদে ফেলে দেয়াটা কেউ সমর্থন করতে পারল না।

যাহোক, সব কিছুই এগিয়ে চলল নিজ গতিতেই।
একদিকে ছেলের কেসের পিছনে টাকা আর সময় ব্যয় করতে করতে অধীর প্রায় কপর্দক শুন্য হয়ে পথে বসার উপক্রম হল।
অন্য দিকে পরিকল্পনা মত জীবন তার জমিতে একটা অত্যাধুনিক ষ্টীল মিল তৈরী করল। ইন্ডাস্ট্রি চালনা করার জন্য একজন সিইও’র নেতৃত্বে সব ধরনের লোকবল নিয়োগ দিল। তারপর একদিন এলাকার মন্ত্রিকে দিয়ে একটা জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেটা উদ্বোধন করল।
লালিত স্বপ্ন পুরনের প্রশান্তিতে জীবন ডুবে রইলো।

এমনি সময় একদিন খুব ভোরে দারোয়ান জানাল যে জীবনের নিজ অঞ্চল থেকে একজন বয়স্ক লোক তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকটা বলেছে যে সে অনেক কষ্টে এ বাসার ঠিকানা যোগাড় করেছে, সাহেবের সাথে দেখা করা তার খুব দরকার।
এমনিতেই দয়ালু মানুষ জীবন। দারোয়ানের বর্ণনা শুনে অদেখা লোকটার জন্য তার মনটা কেন জানি ব্যথাই মোচড় দিয়ে উঠল।
লোকটাকে গেস্ট রুমে নিয়ে হাত মুখ ধুতে দিয়ে খাবার দিতে বলে একটু বাদেই আসবে বলে দারোয়ানকে জানালো জীবন।

মিনিট দশেকের মধ্যে জীবন নেমে আসলো। গেস্ট রুমটার দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখল জীর্ণ পোশাকে বসে একজন ক্ষুধার্ত মানুষ যেন গোগ্রাসে খাবার খাচ্ছে। কোন দিকে খেয়াল নেই।
পিছিয়ে আসলো জীবন। ভাবল -লোকটা আগে খাওয়া শেষ করুক।
ফিরে আসলো নিজ কক্ষে।
-অঞ্চলের মানুষ বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে। চেনা জানা কেউ নিশ্চয় হবে। কিন্তু যতটুকু দেখল তাতে তেমন মনে হল না জীবনের। ভাবল ঠিক আছে খাওয়া শেষ হলে দারোয়ান নিশ্চয় ডাকবে ওকে।
বেশ অনেক্ষন হল কিন্তু দারোয়ান না ডাকাতে জীবন আবার নিচে নামলো। দেখল দারোয়ান দাঁড়িয়ে।
-স্যার, লোকটা খেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আমি আর আপনাকে ডাকিনি।
-আচ্ছা, আমি অফিসে বসছি, ঘুম থেকে উঠলে ওনাকে নিয়ে এসো।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর দারোয়ানের ডাকে ফিরে তাকাল জীবন। ওর পাশে দাঁড়িয়ে উস্ক খুস্ক চুল দাড়িতে ভরা একজন বয়স্ক মানুষ। ময়লা জামা পাজামা পরনে।
ঈশারাই তাকে সোফাতে বসতে বললো।
-সাহেব আমার একটা চাকরীর খুব দরকার। আপনার কারখানায় কত ধরনের মানুষ কাজ করে আমাকে ছোট খাট একটা কাজ দিলেই সংসারটা নিয়ে সকলে প্রাণে বাচতে পারব।
কথার মধ্যে আঞ্চলিকতার টান। ও যে জীবনের অঞ্চলের কেউ সেটা বুঝতে একদম কষ্ট হল না।
-আমি খুব অসহায়, যে কোন কাজ আমি করব। সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে অবনতমস্তকে সে ভাবে দাড়িয়েই কথা বলতে লাগলো লোকটা।
জীবনের কাছে ওর কণ্ঠস্বরটা কিছুটা চেনা লাগলো।
-কে আপনি, পরিচয়টা একটু দেবেন।
জীবন চেয়ার থেকে উঠে লোকটার কাছে আসলো। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল- আপনার নামটা কি?
এবার কান্নাই ভেঙ্গে পড়ল লোকটা।
ওকে চিনতে আর বাকি রইল না জীবনের।
-তুমি অধীর সে কথা বললেই তো হয়। তা তোমার এ অবস্থা কেন?
অধীরের হাতটা ধরে জীবন তাকে সোফাই বসাল।
-এত বড় শহর, তোমার ঠিকানা খুজে বের করে এ পর্যন্ত পৌছাতে আমার সাত দিন লেগেছে। তুমি বিদেশে থাকা কালীন একটা ফোনেই তোমাকে নিমেষেই খুজে পেতাম, কিন্তু সেদিন জরিপের সময় আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে খুজিনি। কিন্তু দেখ আজ এত কাছে থাকতেও আমার প্রয়োজনে খেয়ে না খেয়ে ফুটপাথে রাতে ঘুমিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করতে সাত দিন লেগেছে।
অনুশোচনায় দুমড়ে মুছড়ে কাঁদতে লাগলো অধীর।
অনুশোচনায় ভরল জীবনের মনও। অধীরের ছেলের বিরুদ্ধে করা কেসের কথা এতদিনে মনে পড়লো তার। সে সময় রাগের মাথাই অত বড় একটা গর্হিত কাজ করার জন্য একটা তীব্র অপরাধ বোধ জন্ম নিল জীবনের মনে। ভাবল ওর ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করবে কি? কিন্তু সাহস হল না।
-ছেলেটার জেল হয়েছে। ওর কেসের পিছনে জমি জমা যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়ে বলতে গেলে এখন পথে বসেছি।
কথাটা শুনে জীবন যেন দুপায়ের জোর হারিয়ে ফেললো।

আকাশ মেঘে ঢেকে মুখ ভার করে আছে। সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চলল কিন্তু বেলা দেখে তা বুঝার কোন উপায় নেই। মেঘ গুড়ু গুড়ু করে অবিরাম যেন গোঙাচ্ছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হল।
টেলিফোন বাজার শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে জীবন ধরল টেলেফোনটা।
জীবনের ইন্ডাস্ট্রিতে বাজ পড়েছে আকাশ থেকে। এ্যাডমিন বিল্ডিং সহ পাওয়ার হাউজটা পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অলৌকিক ভাবে মুল ইন্ডাস্ট্রির কিছু হয়নি।
টেলিফোন রেখে জীবন তাকাল অনুশোচনায় মুছড়ে পড়ে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে সোফার এক প্রান্তে উপবিষ্ট অধীরের দিকে।
কেন জানি জীবনের মনে হতে লাগলো, ওর ইন্ডাস্ট্রির উপর বাজ পড়ার ঘটনাটা অধীর আঁচ করতে পেরেছিল, আর ওর দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর জন্য ও এসেছে এখানে। অধীরই যেন গত সাত দিন ধরে বিধাতার সাথে দেন দরবার করে জীবনের ইন্ডাস্ট্রিটা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
জীবন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু হারিয়ে সোফার অন্য প্রান্তে ধপ করে বসে পড়লো।
প্রতিশোধ নেয়ার পদক্ষেপ নেয়ার আগে নাকি দুটো কবর খুড়তে হয়। কেবল মনের জ্বালা মিটাতে প্রতিশোধ নিতে নিজ নিজ যুদ্ধে পরাজিত দুই সৈনিক একই সোফার দুধারে উপবিষ্ট।
দুজনেই তাদের কাছে গচ্ছিত বিশ্বাসের অবমাননা করেছে।

স্বর্গের আত্মা আর মর্তের শরীর এ দুয়ে মানুষ। মন শরীরের অংশ। স্বর্গে যেমন বিন্দুমাত্র নেতিবাচকতার স্থান নেই, তেমনি মর্তে বিন্দুমাত্র নেতিবাচকতা ছাড়া কোন কিছুই নেই। মানুষের অবস্থান দেবত্ব আর পশুত্ব এই দুই প্রান্তরেখার ভিতর বিস্তৃত। চেতন মনে মানুষ কোন দিককার রেখাই অতিক্রম করতে পারে না।
মানুষ অপরাধ করে বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে পুরোপুরি মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে। অপরাধী যখন নিজের ভুলটা বুঝে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে সে মুহূর্তে মনের নিয়ন্ত্রন শিথিল হয়ে আত্মার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ তখন স্বর্গ প্রান্তরেখার কাছাকাছি চলে আসে।
প্রকৃত অনুতপ্ত মানুষের চেহারাতে স্বর্গীয় দ্যুতির বিচ্ছরন হয়।

-ওঠ ভাই, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা অক্ষত আছে, ওটা দাড় করাতে একটু সময় লাগবে কিন্তু কোন সমস্যা হবে না।
মুখ তুলে অধীর তাকাল। খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হল না।
-এবার আর কোন ভুল নয় অধীর, সব মেনে নিয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য যতটুকু দরকার তার থেকে একটুও বেশী কিছু করব না।
একটা চাপা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে অধীরের কাছে ঘন হয়ে বসলো জীবন।
-চল, আমরা রওয়ানা হব, নতুন করে আমাদের সব শুরু করতে হবে। আর তোমার ছেলের বিদেশে যাওয়ার দরকার হবে না