জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -৫।

আপডেট: ১১ Jun ২০২৩, ০৯:৪০

জীবনের অন্যপিঠ- ৫  

 

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিল তরুন ডাক্তার অনিরূদ্ধ।
-সেদিন একজন মাঝ বয়সী রোগী আসলো। সমস্যা, সোমত্ত মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না, সে জন্য দুশ্চিন্তায় ঘুম হয় না রাতে। আমি বললাম- আমিতো রোগের চিকিৎসা করি, মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য কি করতে হবে তার সমাধানতো আমার কাছে নেই।
একটু থামলো অনিরূদ্ধ।
-মাথাটা নিচু করে নীরবে চলে যাচ্ছিলো লোকটা। খুব খারাপ লাগলো। থামালাম ওকে। পাশে বসালাম।
-ও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো আমার দিকে।
-ডাক্তার সাহেব, অসুখ বিসুক খুব একটা হয়না আমার। গা মাথা ব্যথা করলে একটু মালিস লাগালে বা ফু দিয়ে ঝেড়ে নিয়ে একটু ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যায়। ওধরণের কোন রোগের জন্য নয়, সমস্যার জন্যইতো আগে কবিরাজের কাছে আসতাম।
ওর দিকে তাকিয়ে নীরবে তার কথা শুনতে থাকা রামদয়ালকে একটু গভীর ভাবে দেখে নিল অনিরূদ্ধ।
-আর একদিন, দশ বারো বছরের একটা ছেলে আসলো। লাইনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে যখন আমার পর্যন্ত পৌছালো তখন সে আমার দিকে না দেখে ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। বুঝলাম কাকে যেন খুজছে। ওর চোখ মুখ একেবারে ভাবলেশহীন। জিজ্ঞেস করলাম ওর কি অসুখ। কোন জবাব দিল না।
-নীরবে চলে যাচ্ছিলো ছেলেটা, আমি কৌতুহলবসতঃ উঠে ওর গায়ে হাত রেখে একটু আদর করে জিজ্ঞেস করলম -বল তোমার কি হয়েছে, চলে যাচ্ছ কেন?
নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানালো, কোন অসুখ নেই ওর।
জিজ্ঞেস করলাম -তবে এসেছিলে কেন?
-একটু ইতস্ততঃ করে বললো -কবিরাজের সাথে দেখা করতে।
-ওকে বসিয়ে ওর সাথে কথা বলে জানলাম যে ওর বাবা নেই। মা অন্য মানুষের বাসায় কাজ করে। মা বেটা মিলে রাতে স্কুলের বারান্দায় ঘুমায়। ও প্রাইমারী স্কুলের ঘণ্টা বাজায় আর সে সুবাদেই ওখানে ফ্রী পড়াশোনা করে। এবার ক্লাস ফোরে উঠেছে। কাকে যেন বলে ওকে এক সেট পুরনো বই যোগাড় করে দিতে হবে সে জন্যই খুজছিল কবিরাজকে।
কথা গুলো বলতে বলতে অনিরূদ্ধ অপলক নেত্রে দেখছিল রামদয়ালকে।


-রামদয়াল আমি মানুষের শরীরের রোগ সারানোর ডাক্তার। আমার যা যৎসামান্য জ্ঞান আছে তা কেবল শরীরকে নিয়ে। এর বাইরে অন্য কোন রকম সমস্যা চিকিৎসার জ্ঞান আমার নেই।
-আর শরীরেরও সব চিকিৎসা কি করা যায়!
কিছুটা স্বগত স্বরে কথাটা বলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো অনিরূদ্ধ। প্রশ্নটা কি রামদয়ালকে করলো না নিজেকে করলো তা ঠিক বোঝা গেল না।
একটু যেন অন্যমনষ্ক অনিরূদ্ধ।
রামদয়াল ওর মোটা ফ্রেমের চশমার ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তরুন ডাক্তারকে।
-ভালো ভাবে জ্ঞান হওয়ার পূর্বে সব চাহিদার কেন্দ্র ছিল এই শরীর। শরীরের কথায় চলতাম। তারপর যখন জ্ঞান হলো তখন ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম যে এই শরীরটা বিধাতা দিয়েছেন জীবনটাকে ব্যস্ত রাখার জন্য, শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য।
আর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো ওর বুক খালি করে।
রামদয়াল তেমনি ভাবে তাকিয়ে অনিরূদ্ধর দিকে।

রামদয়ালের সাথে অনিরূদ্ধর বয়েসের পার্থক্য বেশী না।
কিন্তু এই মুহুর্তে অনিরূদ্ধর সমস্ত অবয়ব, ভাবভঙ্গি দুর্বোধ্য লাগলো রামদয়ালের কাছে।
অনিরূদ্ধ বড়লোক বাবার সন্তান। ওর বাবা বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার। সারাটা জীবন তিনি মধ্য প্রাচ্যের এক দেশের সরকারের অধীনে চাকরী করে জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
তরূন বয়সে চাকরী নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর নিয়তির টানে থেকেই গিয়েছিলেন সেখানে।
আরব দেশের এক মেয়ের সাথে পরিণয় সূত্রে বিয়ে হয়েছিল ওদের। আরবের মত অতি রক্ষনশীল দেশে প্রেম করে বিয়ে করা তদুপরি আরবী মেয়ে বিয়ে করা একটা ঝক্কি ঝামেলার ব্যপার।
যাহোক, ওর নিজের দীর্ঘ দিনের অর্জিত নাম যশঃ আর কাজের দক্ষতায় আরব সমাজের কিছু নামকরা বংশের ব্যক্তির নেকনজরের জন্য ওদের বিয়েটা সম্ভব হয়েছিল।
জীবনের মূল্যবান সময়ের সবটুকু মধ্যপ্রাচ্যে কাটিয়ে এবং অবশেষে যাযাবর পরিবারের আরবী একজন মেয়েকে বিয়ে করেও তিনি সেখানকার নাগরিকত্ব পাননি। ওর স্ত্রী আরবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মহিলা বলে অনারব স্বামীকে ওদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যপারে কোন সাহায্য করতে পারেনি।
অনিরূদ্ধর জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে, ওখানেই একটা ইংরেজী স্কুলে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু উচ্চ লেখাপড়া শেখার সুযোগ সেখানে তেমন না থাকায় স্কুল পাশ করার পরই বাবা ওকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
লেখাপড়া শেষ করে অনিরূদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ফেরত গিয়েছিলো। ইচ্ছা ছিল জন্ম যেখানে হয়েছে, ব্যল্যকাল যেখানে কেটেছে টেনে হিচড়ে বাল্যের স্মৃতি রোমত্থন করে জীবনটা কোন রকমে কাটিয়ে দেবে ওখানে।
নাগরিকত্ব দরকার নেই। কিইবা করবে ওটা দিয়ে, একটা জীবন কোন রকমে টেনে নিতে বসবাসের অনুমতিটায় যথেষ্ট।

বয়স হয়েছে কিন্তু বিয়ে করে সংসার করবে না সে ব্যপারটি আরবের মত অতি রক্ষনশীল সমাজ যেন মেনে নিতে একদম নারাজ। সমাজের মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের বদৌলতে অনিরূদ্ধ বুঝলো ওখানে এ ভাবে নিজের মত হয়ে জীবন চালানো যাবে না।
ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারছিলো না।
ভাবলো লন্ডন বা পশ্চিমা দুনিয়ার অন্য কোন দেশে চলে যাবে। পশ্চিমা দুনিয়াই নিজের মত করে থাকা যায়।
কিন্তু সেখানেও ওর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা। চাক্ষুস বৈষম্য আর ধর্মীয় বৈষ্যমের যে স্বরূপ সে দেখেছে তাতে ওর মন সাঈ দিল না।
খুব অস্বস্থিতে দিন কাটাছিল। তারপর ওর এক বন্ধুর মাধ্যমে জমিদার অমর চৌধুরীর নামে কাগজে দেয়া বিজ্ঞাপনের কথা জানতে পেরে শেষ পর্যন্ত এখানেই চলে আসলো।
বাকি সময়টা এখানে কাজের মধ্যে লুকিয়ে যদি কাটানো যায়! সেটা ভেবে এই অপরিচিত পরিবেশে এসেছে সে।

-আপনাকে মনে মনে খুজছিলাম বেশ কয়েকদিন ধরে।
রামদয়াল তাকালো অরিূদ্ধর দিকে।
-আপনিও বসবেন আমার সাথে রোগী দেখার জন্য। সেবাটাকে ধর্ম ভেবে এখানে আমার আসা। আপনার সাহায্য বাদে আমার পক্ষে সে কাজ করা সম্ভব নয়।
কি যেন একটা ভাবলো অনিরূদ্ধ তারপর বললো -আপনিতো জানেন যে জমিদার তার প্রজাদের কল্যানের জন্য কি না করছেন। সবকিছুকেই ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চায় মানুষটা। আমিও এসেছি তার সাথে ডুব দেব বলে।
অনিরূদ্ধকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো রামদয়াল।
-এখানে একটা বড় হাসপাতাল তৈরীর নক্সা বানানোর কাজটা শেষ। অল্পদিনের ভিতরই বোধহয় নির্মাণ কাজ শুরূ করবেন জমিদার। অনেক বড় আর মহৎ উদ্দেশ্য তার। এছাড়াও প্রাইমারী স্কুলটা হাই স্কুল হচ্ছে, আরো রাস্তা ঘাট বাজার ইত্যাদি তৈরী হচ্ছে।
এত অল্পসময়ের মধ্যে নতুন জমিদার এতকিছু করছেন। ভারী ভালো লাগলো রামদয়ালের। জমিদারের মাথার মধ্যে কত চিন্তা ভাবনা! রামদয়াল ওর একটা কাজ নিয়েই কেমন হিমসিম খায়। জমিদারের এত সব পরিকল্পনা কার্য্যকরী করতে হলে আমাদের সকলের নিজেদের দেয়া কাজটুকু ঠিকমত সম্পাদন করতে হবে, না হলে তার পক্ষে এতসব প্রজাহিতকর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
ভাবছিল রামদয়াল।
-আপনার সময় মতোই আপনি আসবেন, এ নিয়ে বাধা ধরা কিছু নেই। অন্য কাজ থাকলে সেদিন না হয় না আসলেন।
রামদয়ালকে অন্যমনষ্ক হওয়া দেখে বললো অনিরূদ্ধ।
অনিরূদ্ধ সম্পর্কে পুরো ধারণাটায় পরিবর্তন হয়ে গেল রামদয়ালের। রামদয়ালের এহেন অবস্থার জন্য মনে মনে অনিরূদ্ধকে কিছুটা দায়ী করে অযথায় ওকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছিল।
প্রায় একই বয়সের একটা অচেনা মানুষের প্রতি অযথা এমন একটা নেতীবাচক ধারণা পোষন করার জন্য নিজের কাছে খুব ছোট মনে হলো রামদয়ালের।
বাইরেটা দেখে আর খন্ডিত কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে কাউকে বিচার করলে তা যে কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে তা অনুমান করলো রামদয়াল।
আসলে সব দেখা বা সব শোনা সত্য নয়।

ডাক্তারখানার সামনে ঠেলাগাড়ী থেকে ঈট নামানোর শব্দে ওরা তাকালো সেদিকে।
-স্যার, হাসপাতাল বানানোর জন্য ঈট আসছে। আর একজন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসেছেন কাজের ব্যপারে। জমিদার ওকে আপনার সাথে আলোচনা করার জন্য বলেছেন।
কম্পাউন্ডার করিমের কথাগুলো শেষ না হতে হতেই সার্ট প্যাণ্ট পরা একজন তরূন বয়সী ভদ্রলোক প্রবেশ করলো।
নিজেকে আলম বলে জানিয়ে সে একজন এ্যাসিসট্যণ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচয় দিল। কনসট্রাকশানের ব্যপারে অনিরূদ্ধর সাথে আলাপের প্রয়োজনের বলে জানালো।
ওরা দুজনই তাকালো তরূন ইঞ্জিনিয়ারের দিকে।
আলম বসলো একটা খালি চেয়ারে।
-বেশী সময় নেব না আপনার। অনেক বড় প্রজেক্ট, তায় কাজগুলো কয়েকটি পর্যায়ে শেষ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে আপনার আর একজন মহিলা ডাক্তারের চেম্বার সহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কিছু রূম যেমন মেডিসিন রূম, রোগীদের জন্য বিশটা বেড এগুলোর কাজ আগামি সপ্তাহেই শুরূ হবে।
হাতে ধরা একটা নক্সা খুলে সেটা টেবিলের উপর বিছাতে বিছাতে বললো আলম।
নক্সাগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে অনিরূদ্ধ রূমের সাইজ গুলো পরীক্ষা করে ওর মন্তব্য দিতে লাগলো।
জমিদারের কথা উল্লেখ করে অনিরূদ্ধ রক্ত আর মল মুত্র পরীক্ষার প্রাথমিক কিছু সুযোগ সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত রূমের প্রয়োজন ইত্যাদি ব্যপারে আলোচনায় ডুবে গেল।
রামদয়াল বুঝলো এরা দুজনেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এ যুগের জন্য মানানসই মানুষ। ওদের অনেক কথাবার্তাই রামদয়ালের কাছে অবোধ্য মনে হলো।
ওদের দুজনের একাগ্রচিত্তে আলোচনার সবটুকু না বুঝলেও এতটুকু বুঝলো যে এই দুই তরূনের কাজের ক্ষেত্র আলাদা হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন -জমিদারের পরিকল্পিত আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা।

সব ভুলে ওরা আলোচনায় ব্যস্ত।
কর্মডোবা মানুষের ওই এক অপরূপ চেহারা।
পিছনের দরজা দিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে গেল রামদয়াল।