সত্য ঘটনাকে সাহিত্যের ছোঁয়া লাগিয়ে রচিত ছোট গল্প 'ভালবাসার শক্তি'

আপডেট: ২০ Jul ২০২২, ১৩:২৪

ভালবাসার শক্তি

 

যে উদ্দেশ্য নিয়ে কোন একটা কথা বলা হয় বা কাজ করা হয়, সেটা যদি সেভাবে না বুঝে অন্যরা নিজের নিজের মত করে বোঝে তাহলে বিপদ। ভাবার্থ না বুঝে আক্ষরিক অর্থে নিলে নির্বিষ রসিকতাও চরম মান হানিকর প্রতীয়মান হয়ে মারাত্মক হানাহানির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
তেমনি একটা ঘটনা ঘটলো এ্যালফির বেলায়।

কিছু বাচ্চা আছে যারা আপন পর বিচার না করে যাকে দেখে তার গা জড়িয়ে কোলে উঠতে চায়। কাউকে হাতের নাগালে পেলেই চেনা অচেনা বিবেচনা না করেই তার কাছ থেকে আদর পেতে চায়। এ ধরনের বাচ্চারা অনেক সময় অনেকের বিরক্তির কারণও হয়ে দাড়াই।
এমনই স্বভাবের একটি বাচ্চা এ্যালফি। কতই বা বয়স ওর, বড় জোর বছর দেড়েক হবে। বাড়ন্ত শরীর ওর তাই এ বয়সেই ওকে বড়দের মত দেখাই।
এই তো সেদিন খোকা ওকে আদর করে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে আমার কোলে দিতেই আমার অনভ্যস্ত হাত থেকে মেঝেই পড়ে যেয়ে ও ব্যথা পেয়ে কিচ কিচ শব্দ করে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় খোকা তাড়াতাড়ি মেঝেই বসে পড়ে এ্যালফিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো।
আমি হতবিহবল হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপর আমিও খোকার পাশে মেঝেতে বসে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলাম।
আফসোসে মনটা ব্যথিত হল।
খোকা জানালো এর নাম এ্যালফি ও আমাদের বাসার নতুন অতিথি।
ওর দিকে ভাল করে তাকালাম। ধপধপে সাদা লোমে ভর্তি এ্যালসেসিয়ান জাতের কুকুর ছানা। কিছু চেহারা থাকে যা প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নেয়, এ্যালফি তেমনি।

এ ভাবেই শুরু হল আমাদের তিন জনের পরিবারের সাথে চতুর্থ সদস্যের যাত্রা।
খোকার সাথেই উপরে তিন তলাই খোকার রুমে রাতে ঘুমাই এ্যালফি। দিনের বেলা নিচে নামিয়ে দিলে খোলা গ্যারেজে খেলা ধুলা করে দিন কাটাই।
নিচে নাম্লে আমরা যে যখনি ওর পাশ দিয়ে যায় ও বাচ্চা গলাই কুচ কুচ করে ডেকে পা জড়িয়ে ঘরে কোলে উঠতে চায়।
মাস ছয়েকের মধ্যেই এ্যালফি বেশ বেড়ে উঠে বড় হয়ে গেল। তাতে ওর গলার স্বরটাও পরিবর্তন হয়ে মোটা গলাই ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করলো। আর সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে দৌড়ে গিয়ে তাদের গায়ে উঠার প্রবনতাও বেড়ে গেল। তাই বাধ্য হয়েই ওকে সারাদিন রশি দিয়ে বেধে রাখার ব্যবস্থা করা হল।
বাধা অবস্থায় থেকেও এ্যালফি কাউকে বাসার সামনে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে আর ওর গলার বেল্টের সাথে বাধা রশিটা দাতে কেটে ছিড়তে চেষ্টা করে।
রশিটা ওর দারুন অপছন্দ। দুএকবার রশি ছিড়ে দৌড় দিয়ে রাস্তাই নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে এ্যালফি।
বাসার গার্ড ছেলেটা প্রানন্তকর হয়ে ওকে ধরে এনে নতুন রশিতে বেধেছে।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল রাতে যখন এ্যালফিকে ঘুমানোর জন্য খোকা উপরে ওর রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্দ করে ওকে রশি মুক্ত করে দেয়, এ্যালফি যেমন ভদ্র ভাবে ঢোকে তেমনি কোন রকম কোন শব্দ না করে খোকার ঘরে সারা রাত থাকে।
খোকার পাশে বসে থাকে বা রুমের ভিতর হাটাহাটি করে বা খোকার সাথে টিভি দেখে তারপর খোকা ঘুমিয়ে পড়লে এ্যালফিও একটা নরম ম্যাটের উপর শুয়ে পড়ে।
উপরে খোকার শোয়ার ঘরে এ্যালফি আর নিচে নামিয়ে দেয়ার পর গ্যারেজে রশিতে বাধা এ্যালফি যেন ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা।
নিচে আসলে এ্যালফি রশি কাটার জন্য প্রাণান্তকর হয়ে ওঠে। নিচে সারাদিন ওর কাজই যেন রশি ছেড়ার প্রচেষ্টা। কয়েকদিন পর পর ও দাত দিয়ে রশি কেটে ফেলে। আর বন্ধন মুক্ত হয়েই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। গার্ড ছেলেটা ওকে ধরতে চাইলে ও প্রথমে গ্যারেজের মধ্যে ছুটাছুটি করে গাড়ীর এধারে ওধারে লুকোচুরি খেলে ছেলেটাকে হয়রান করে তারপর এক দৌড়ে বাইরে রাস্তায় বের হয়ে যায়। গার্ড ওর পিছনে ছুটতে ছুটতে অন্য কোন লেন থেকে ধরে আনে।
এ্যালফির এধরণের আচরনের জন্য খোকা ওকে বকাবকি করে আর ওকে শান্ত রাখার জন্য দু একদিন পর পর বিকেলে বাইরে থেকে হাটিয়ে নিয়ে আসে।

এভাবেই এ্যালফিকে নিয়েই আমাদের পরিবারের জীবন কাটে। সব কিছুই এ্যালফির সাথে মানানসই করে চলতে হয়। অনেকটা বাড়ীতে অতি দুষ্টু বাচ্চা পালন করার মত।
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় এ্যালফি আমাকে আদর করার ছলে পিছনের দু পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে। আবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় ওই একই রুটিন। অনেকদিন সকালে বের হওয়ার সময় ও আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরার জন্য পিছনের দুপায়ের উপর ভর করে দাড়ালে আমি একটু দূর থেকে ওর ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চায় কারণ একটু হলেও ও আমার জামা প্যান্ট নষ্ট করে দেয়। এভাবে দূর থেকে আদর করে গাড়ীতে উঠে রওয়ানা দিলে এ্যালফি মন খারাপ করে অভিমানি চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি সেটা বুঝি আর অফিস থেকে টেলিফোন করে গার্ডের কাছ থেকে জানতে চায় এ্যালফি কি করছে। ও বলে এ্যালফি পুরো খাবারটা খায়নি।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়। সেদিন অফিস থেকে ফিরে নিচে এ্যালফিকে নিয়ে কিছু সময় খেলা ধুলো করে ওর মনটা হালকা করে উপরে উঠি।
রাত দশটা অব্দি এ্যালফিকে উপরে না আনলে ও হাক ডাক শুরু করে প্রতিবেশীদের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। খোকা যেখানেই থাক টেলিফোনে ওকে ডাকতেই হয় এ্যালফিকে নিয়ে ওর ঘরে উঠানোর জন্য। খোকাকেও তাই রাত দশটার মধ্যে ঘরে ফিরতে হয়।
এ্যালফি খুব ঘন ঘন রশি কেটে ছিড়ে ফেলে বলে খোকা ওর জন্য একেক বারেই চার পাচটা করে রশি কিনে রাখে।
সে সবে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু সেদিন সত্যি সত্যেই অসুবিধা একটা হয়ে গেল।

সেদিন ঠিক সন্ধ্যার পর পর এ্যালফি গার্ড ছেলেটার অলক্ষে রশি কেটে বেরিয়ে রাস্তাই চলে গেল। আর ওই সময় রাস্তা দিয়ে গমনায়নরত ছয় সাত বছরের বাচ্চা সহ এক ভদ্র মহিলা আর তার ছোট বাচ্চাকে আদর করার ছলে এ্যালফি ওদের গায়ে উঠলো। তাতে মহিলা আর তার বাচ্চা ভয় পেয়ে চিৎকার করে এ্যালফিকে ভুল বুঝে ওর হাত থেকে নিজেদেরকে বাচানোর জন্য ওর সাথে ধাক্কা ধাক্কি করার সময় এ্যালফির নোখের আঁচড়ে ওরা আহত হল।
মহল্লা বাসী জড় হয়ে নানা বিরুপ মন্তব্য করে এই খ্যাপা কুকুরকে মহল্লাই রাখা যাবে না ইত্যাদি বলে জানিয়ে গেল অন্যথায় বিষয়টি নিয়ে তারা আইনের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও জানালো।
আহত মহিলা আর বাচ্চাটার জন্য সবাই সমবেদনা জানিয়ে ওদেরকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। পুরো ব্যাপারটার জন্য আমার খুব খারাপ লাগলো। ভীড় কমলে আমি ভদ্র মহিলা আর আহত সন্তানের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম আর মহিলা আর তার স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এ্যালফি কোন খ্যাপা কুকুর না আর ওকে বিভিন্ন রকম ইংজেকসান দেয়া আছে বলে নিশ্চিত করলাম।
কিন্তু মহিলা আর তার স্বামী বিশেষ করে তাদের বাচ্চার কথা উল্লেখ করে বারংবার অনুরোধ করলো যে এ রাস্তা দিয়েই তারা তাদের সন্তানকে নিয়ে প্রায়শই তাদের যাতায়াত করতে হয় আর প্রতিদিন কুকুরটা ওদেরকে দেখলে বিকট ভাবে ডাকা ডাকি করে তাতে ওরা এমনিতেই ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। তাই এ ঘটনার পর কুকুরটাকে সরাতে হবে বলে জোর দাবী করে বসলো।
যাহোক, খোকা ফিরে সব জেনে অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ইতিমধ্যে কমুইনিটি পরিষদ থেকেও প্রতিবেশীদের অভিযোগের কথা উল্লেখ করে এ্যালফিকে দু একদিনের মধ্যে অন্যত্র সরানোর তাগিদ দিয়ে গেল।
খোকার সাথে একান্তে কথা বললাম। খোকা নিরুপায়ের মত এ্যালফিকে স্থানন্তরের পক্ষে ওর সম্মতির কথা জানালো।
পরদিন আমি শহরে পশু কেনাবেচা কারীদের সাথে যোগাযোগ করতেই এ্যালফির মত এত সুন্দর একটা কুকুরকে পরদিন সকালে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করল।
ওরা ব্যবসায়ী তাই নিজের থেকেই এ্যালফির একটা ক্রয় মূল্য আমাকে দেবে বলে বলল।
এতক্ষণে আমার চোখদুটো অশ্রসিক্ত হয়ে উঠলো।
ওদেরকে জানালাম ভালবাসা কেউ কখনো সওদা করে না। কারণ সেটা অমুল্য।
বলালাম এ্যালফিকে আপনারা এমনিতেই নিয়ে যান তবে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে। বললাম আমাদেরকে কথা দিতে হবে যে এ্যালফির ক্রয়কারীর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার আমাদেরকে দিবেন যাতে এ্যালফির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ওর নতুন মালিককে জানাতে পারি আর আমরা মাঝে মধ্যে এ্যালফিকে দেখে আসতে চায়।
ওরা আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে পরদিন সকালে এ্যালফিকে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করল।
খোকা সব কথোপকথন শুনে অসহায়ের মত তাকিয়ে রইল।
-বাবা আমি পশু বেচাকেনা মার্কেটে অনেকবার গিয়েছি এ্যালফির জন্য জিনিসপত্র কেনার জন্য, আমি দেখেছি কি ভাবে ছোট্টো খাচার ভিতর এ্যালফির মত কুকুরদের ওরা রাখে।
খোকার চোখ দুটোতে অশ্রু ছল ছল করে উঠলো।
খোকা সন্ধ্যার পর পরই নিজের রুমে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্দ করে দিল।

পরদিন সকালে এ্যালফিকে নিয়ে যাবে। খোকার কষ্টটা আমি বুঝলাম। আমি নিচে নেমে এ্যালফিকে অনেক করে আদর করলাম। পরিষ্কার বুঝলাম অন্যদিনের মত এ্যালফি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ও কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে রইলো।
আমি উপরে উঠে আসলাম। আমার স্ত্রী এ্যালফির জন্য কেনা সব সরঞ্জামাদি যেমন ওর গলার বেল্ট কিছু খেলনা আর শুখনো খাবার একটা প্যকেটে গুছিয়ে দিল। সকালে ওগুলো এ্যালফির সাথে দেয়ার জন্য।
আমাদের চোখাচোখি হল কিন্তু একটাও কথা হল না।

সন্ধ্যা হতে না হতেই বাসায় যেন গভীর রাত হয়ে গেল।
রাত বারোটার দিকে খোকা আমাদের রুমে এসে জানাল যে, ও এ্যালফিকে নিয়ে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওর বন্ধুর বাবার একটা ফার্ম হাউজে রাখতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ওর বন্ধু আর তার বাবার সাথে ওর কথা হয়েছে বলেও জানালো খোকা।
ওর বন্ধু বাসার নিচে অপেক্ষা করছে, আমাদের গাড়ীটা নিয়ে এ্যালফি সহ ওরা এখনি রওয়ানা দেবে জানিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে খোকা নিচে নেমে গেল। ওর মা কোন মন্তব্য না করে এ্যালফির ব্যাগটা খোকার হাতে দিল।

সামনের ব্যাল্কনিতে এসে দাড়ালাম। নিচে খোকার গাড়ীটা বেরিয়ে যেতে দেখলাম। গভীর রাত বাসার সামনের রাস্তা একেবারে ফাঁকা।
ওভাবে কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক জানি না। কি ভাবছিলাম তাও বলতে পারবো না। টেলিফোন বাজার শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে পেলাম। নির্জন রাস্তাটা ততোক্ষণে বেশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। স্ট্রীট লাইটগুলো তখনও বোকার মত জ্বলছে।
আমি ভিতরে এসে দেখি আমার স্ত্রী ফোনটা রিসিভ করে কথা বলছে।
-মা, এ্যালফিকে শাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে ফার্মে ছেড়ে দিয়েছি। ও একটা ভাল বন্ধু পেয়েছে তার সাথে খেলছে। আমি ভিডিও পাঠিয়েছি বাবাকেও দেখাও। আমি পরে আবার কথা বলছি।
খোকার অনুরোধেই আমার স্ত্রী ফোনটা স্পীকারে দিয়ে কথা বলছিল। তাই আমিও পরিষ্কার সব শুনতে পেলাম।
আমার স্ত্রী অনেকটা উৎফুল্ল হয়ে খোকার সাথে কথা বলছিল। খোকার কণ্ঠেও উৎফুল্লতা ছিল।

এ্যালফির প্রতি আমার ভালবাসার কোন কমতি ছিল না, কিন্তু ওকে অন্যত্র সরানোর ব্যাপারে আমার ভালবাসার সাথে দায়িত্ববোধটাও কাজ করেছিল বলে আমি সহজ পথটা বেছে নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে আমার দায়িত্ববোধটা ভালবাসাকে ছাপিয়ে গেয়েছিল।
কিন্তু বুঝলাম খোকা যেটা করলো সেটা নিরেট ভালবাসা থেকে, যেখানে দায়িত্ব বোধের লেস মাত্র ছিল না।
ভাবলাম -ভালবাসার শক্তি গগনবিদারী।