জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'চুরি করেও সে চোর না'।

আপডেট: ৩১ অগাস্ট ২০২২, ১১:৫০

চুরি করেও সে চোর না


-মন্টু মিয়া, আপনার শরীর ঠিক আছে তো?
-জি স্যার। মনে হল আমার প্রশ্নটা কিছুটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
-তাহলে কি পারিবারিক বা অন্য কোন সমস্যা হয়েছে?
– তেমন কিছু না স্যার, বড় ছেলেটার শরীরটা কয়েক মাস ধরে তেমন ভাল যাচ্ছে না। কিছু খেতে চায় না ছেলেটা আর সারাক্ষন পেট ব্যথার কথা বলে। আমতা আমতা করে জবাব দিল মন্টু মিয়া।
-ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিসের অসুখ ওর?
-কিছু টেস্ট করানো হয়েছে আর কিছু এখনো করাতে হবে। তার পর রোগটা নির্ণয় করা যাবে।
-ঠিক আছে, অত চিন্তা করার কি আছে, ইয়াং ছেলে, ভাল ডাক্তার দেখান, ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাকে জানাতে ভুলবেন না যেন।

বেশ কিছু দিন যাবত মন্টু মিয়াকে কেন জানি অন্যমনস্ক লাগে। কাজ ঠিকই করে কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব।
মন্টু মিয়ার মত একজন মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজেই চোখে পড়ে কারণ সে স্বভাবজাত ভাবে সুখী একজন মানুষ। অল্পে তুষ্ট আর চাহিদা খুবই কম।
অফিসে বসেই তার সাথে কথা হচ্ছিলো। আমার একটা জরুরী কল আসায় তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে হল।
মন্টু মিয়া আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি অর্থাৎ পি এস হিসেবে কর্মরত।
বয়স পঞ্চাশের কোটা ছাড়িয়েছে, আমার থেকে বছর দশেকের বড়। সে ভাবেই আমি তাকে সম্মান দিয়ে আচরণ করি। সে কাজে কর্মে যেমন আন্তরিক তেমনি বিশ্বস্ত। কারখানার অনেক কর্মচারীর মত সেও কারখানার ভিতর কোয়াটারে পরিবার নিয়ে বসবাস করে।

এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। বাবা মারা যাওয়ার পর গত প্রায় দশ বছর ধরে আমিই ব্যবসাটা চালাচ্ছি। বাবা তার নিজের হাতে গড়ে ব্যবসাটাকে একটা মজবুত ভিতের উপর দাড় করে দিয়ে গিয়েছেন, সাথে তার হাতে গড়া একটা দক্ষ এবং বিশ্বস্ত কর্মী বাহিনী। আর কর্মীদের ধরে রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন তিনি যেমন, প্রতি দশ বছর চাকরীর পর গ্র্যাচুয়িটি আর তারপর থেকে কোম্পানির বাৎসরিক মুনাফার অংশের প্রাপ্যতা ইত্যাদি।
বর্তমানে যারা চাকরী করছে তাদের একটা বড় সংখ্যক আমার মত দ্বিতীয় প্রজন্মের।

কোম্পানির ক্যাশ টাকা লেনদেনের কাজগুলো ফাইনান্স এন্ড একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী কোন ক্যাশ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে খরচ করা বা রেখে দেয়া নিষেধ। প্রতি দিনই টাকা ব্যাংকে জমা করে প্রয়োজনে আবার ব্যাংক থেকে তোলা হয়। এ ধরনের কাজের সাথে পিএস মন্টু মিয়া সরাসরি সংশ্লিষ্ট না।
এ ব্যাপারে তার কিছুটা সংশ্লিষ্টতা আসে সাপ্তাহিক বা অন্য ছুটির সময় যখন ব্যাংক বন্দ থাকে তখন। সেদিন ক্যাশ টাকা একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট একটা রেজিস্টারে সাক্ষরের মাধ্যমে পিএস এর কাছে জমা করে আমার অফিস কমপ্লেক্সে রক্ষিত ভল্টে রাখা হয়। পিএস এ ভল্টের ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। অফিস ছুটির আগে ভল্টে তালা লাগিয়ে রেজিস্টারে আমার সাক্ষর নেয়। নিয়ম মত পরবর্তী ব্যাংক খোলার দিন সকালেই সে টাকা একাউন্টস ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি বুঝে নিয়ে ব্যাংকে জমা করে দেয়।
এ ভাবেই ইউকেন্ডে বা কোন ছুটির দিনের আগে পিএস এর দায়িত্বে ভল্টে পাচ দশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ পর্যন্ত টাকা জমা থাকে।
মন্টু মিয়ার দুই ছেলে। দুজনই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সে আমার একজন একান্ত কর্মকর্তা আর কারখানায় দ্বিতীয় প্রজন্মের চাকরিজীবী হিসেবে আমাদের পরিবারের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

মন্টু মিয়ার সাথে কথা হওয়ার পর দিনই ব্যক্তিগত কাজে মাস খানেকের জন্য দেশের বাইরে যেতে হল।
বাইরের থেকে এসে প্রথম দিন সকালে অফিসে আসলেই মন্টু মিয়া আসলো।
-স্যার, আপনার শরীর ভাল ছিল তো? সব কিছু ঠিক ঠাক মত হয়েছে আশা করি।
মন্টু মিয়া আমার পিএস তাই আমার সাথে এ ভাবে কিছুটা আন্তরিকতার সাথে কথা বলে। তবে আজ তার ব্যবহারটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগলো না। কিছুটা কৃত্রিম ভাবোচ্ছ্বাসপূর্ণ লাগলো।
-স্যার, এদিকে সব ঠিক ঠাক আছে। আমি মন্টু মিয়ার চোখে তাকালাম। মনে হল সে যেন চোখ সরিয়ে নিল।
-স্যার, ভল্টের রেজিস্টারটা আপনাকে দিয়ে সই করিয়ে নেব।
ভাবলাম, এটা তো রুটিন কাজ বলার মত তেমন কোন কথা না! একটু অবাকই হলাম।
-আপনার পরিবারের সবাই ঠিক আছে তো, আর আপনার ছেলেটার কি অবস্থা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-স্যার, মোটামুটি।

আমি বাইরে থাকলে বরাবরই সব ডিপার্টমেন্টের প্রধানরা আমার সাথে সেল ফোনে কথা বলে সব জানিয়ে রাখে। মন্টু মিয়াও কথা বলে কিন্তু এবারে বলেনি। বাইরে থেকে আসলে সিনিয়ররা সবাই অফিসে এসে দেখা করে প্রয়োজনীয় কথা বার্তা বলে যায়। এটাই রুটিন।
কিন্তু আজ আমার রুমে কেউ কথা বলতে আসলে দূ এক মিনিট পর পর মন্টু মিয়ার কোন না কোন অসিলায় ঢুকে পড়াটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলো।
ফাইনান্সের চিফ আসলো। মন্টু মিয়াও প্রবেশ করল, চিফ অনেক কথার মধ্যে কিছু একটা বলতে যেয়ে আবার প্রসঙ্গ পাল্টালো।
যাহোক, দুদিন হয়ে গেল, আমি লক্ষ করলাম ভল্টের রেজিস্টারে আমার সাক্ষরের কথাটা সেদিন মন্টু মিয়া কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেও রেজিস্টারটা সাক্ষরের জন্য আনল না।
মন্টু মিয়া সরল সাদা মনের একজন মানুষ। মনেও যা মুখেও তাই। কিন্তু গত দুদিন ধরে তার বাইরের আচরণ আর মনের ভিতর ঘটতে থাকা বিষয়গুলি ঠিক যেন পরিপূরক না হওয়ার ফলে তার অঙ্গভঙ্গি আর অবয়বে একটা অপরাধীর ভাব ফুটে উঠছে বলে আমার মনে হতে লাগলো।
মন্টু মিয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।
সেদিন ইন্টারকমে ফাইনান্সের চিফকে অফিস ছুটির আধা ঘন্টা পর আমার কক্ষে আসতে বললাম। মন্টু মিয়াকে বলা আছে ছুটির পরে আমি অফিসে থাকলেও সে যেন অপেক্ষা না করে সময় মত ছুটি করে।
অফিস শেষ হওয়ার আধা ঘন্টা পর কথা মত ফাইনান্স চিফ আসলো। ততোক্ষণে মন্টু মিয়া চলে গেছে।
-ভল্টের টাকা জমা দেয়া নিয়ে কি কোন সমস্যা হয়েছে?
আমার সরাসরি প্রশ্নে ফাইনান্স চিফ কিছুটা অপ্রস্তুত হল।
-স্যার, পাচ লাখ টাকা জমা পড়েনি এখনো। ইতস্তত কন্ঠ তার।
-কোন সমস্যা হয়েছে কি?
-না স্যার, মন্টু মিয়া বলেছে এ সপ্তাহের মধ্যেই জমা দিয়ে দেবে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম- ঠিক আছে, আপনি যান, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
ভাবলাম, মন্টু মিয়ার সরলতা প্রকৃত অর্থে এ বিষয়ে রিপোর্টটা আমাকে আগেই দিয়েছে।

-কেন করতে হল অল্পে তুষ্ট মন্টু মিয়াকে এ কাজটা! চিন্তা করে কিছুতেই মিলাতে পারলাম না।

পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের তরুন একটা ছেলে আমার পিএ। ছেলেটা আমি অফিসে থাকা পর্যন্ত রিসেপসানে বসে থাকে। ওর বাবাও আমাদের কোম্পানির পুরনো কর্মচারী, কোম্পানির কোয়াটারেই থাকে। ছেলেটা বি এ পাশ করার পর বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিচ্ছে ভাল কোন সরকারী চাকরীর জন্য। এই ফাঁকে গত বছর খানেক ধরে আমার সাথে কাজ করে। অমল ওর নাম।
কি ভেবে অমলকে ডাকলাম। মন্টু মিয়া আর ওরা একই বিল্ডিঙয়ে থাকে। মন্টু মিয়ার বড় ছেলেটা ওর একই বয়সী। ওকে নানা কথাই কথাই জিজ্ঞেস করলাম মন্টু মিয়ার কথা।
-স্যার, মন্টু চাচার ভীষণ বিপদ চলছে!
অমলের কথাই চমকে উঠলাম। কোন এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা কেপে উঠলো।
-কেন, কি হয়েছে মন্টু মিয়ার!
-ওনার বড় ছেলে লিটনের লাং ক্যান্সার। ওকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে।
অমলের কথা শুনে আমার শরীরটা যেন অবস হয়ে গেল।
-আচ্ছা তুমি যাও।

অফিসে বসে আছি, একদম একা। সন্ধ্যেটা অনেকক্ষণ গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। চারদিক নির্জনতায় ভরা। প্রায় পঞ্চাশ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের কারখানা এলাকার এক ধারে পশ্চিম সীমানা ঘেঁসে আমার অফিস কমপ্লেক্স। অফিসের পিছনটাতে বড় একটা লেক তার ওপারে সবুজ বাগান। এ অংশটা মূল ইন্ডাস্ট্রি থেকে আলাদা, আমার অফিস আর বাগান বাড়ী।
গ্লাস আটা জানালার পর্দা সরিয়ে সুইছ টিপে অফিসের লাইটটা অফ করে দিলাম।
আকাশটা মেঘে ঢাকা। কারখানার কিছু ইউনিট চব্বিশ ঘন্টা চলে বলে জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে তাই বিদ্যুৎ চলে গেলেও বোঝার উপায় নেই। বাইরে ল্যাম্প পোস্টের আলোতে গাছ গাছালির বড় বড় ডাল আন্দোলিত হচ্ছে দেখে বোঝা যাচ্ছে বাইরে প্রচন্ড ঝড় বইছে, সেই সাথে বৃষ্টি।
স্বচ্ছ বেলজিয়াম কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে বাইরের সব দেখা যাচ্ছে, বোঝাও যাচ্ছে। ঝড়ে গাছের ডালপালা মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়ছে কিন্তু এই গ্লাস আটা রুমের ভিতর থেকে তার কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না।
বৈশাখ মাস, আম আর লিচু বাগানে কত অপরিপক্ক ফল ফুল অকালেই ঝরে পড়ছে। গাছের ডালে ডালে বাধা কত পাখীর বাসা ডিম আর ছানা সহ ভেঙ্গে পড়ছে। কিন্তু তার কোন শব্দ এই কাচের বেষ্টনী পার হয়ে আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না।
-আমার এই ইন্ডাস্ট্রিতে সব মিলে হাজার খানেক মানুষ কাজ করে। তাদের অধিকাংশ এই কারখানার ভিতরে বা এ অঞ্চলেই পরিবার নিয়ে বসবাস করে। অমল আর লিটনের মত অনেক ছেলেমেয়েদের এখানেই জন্ম আর এখানেই বড় হয়েছে। ওদের বাবা মা আমার কারখানার চাকা সচল রাখার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে। তাদের জীবনের সোনালী সময়টা আমার কারখানার কাজে উৎসর্গ করেছে। তাদের উপর নির্ভর করে মুল শহর থেকে এত দূরে আমার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রেখে আমি নিশ্চিন্তে শহরের বিলাসিতার মধ্যে পরিবার পরিজন বন্ধু স্বজনদের নিয়ে নিরাপদে সময় কাটায়।
আমার ছেলেটা বিদেশে পড়াশোনা করছে। অনেক দিন দেখি না ওকে, তাই ছেলেকে দেখার জন্যই আমি গিয়েছিলাম। সব মিলে আমার প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে এই ট্রিপেই। আর আমারই সন্তানতুল্য একটা ছেলে যার বাপ দাদা নিজের বাড়ী ঘর আপনজন ছেড়ে এই কারখানাতেই কাজ করে জীবনটা কাটিয়েছে, সে ছেলেটা আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। অথচ তার কোন খোঁজ আমি রাখিনা!
-আমার উপর নির্ভর করে এতগুলো পরিবার বেঁচে থাকে, এখানে কাজ করে ওরা ওদের ছেলে মেয়েদের উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে!
-আমি কাচের দেয়ালের ভিতর বসবাস করা মানুষ। আমারই জানালার স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে আমার কারখানার কত মানুষের চিকিৎসার অভাবে প্রাণ যাচ্ছে, সামর্থ্যের অভাবে কত স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। সেগুলো হয়তো আমি দেখছি, শুনছি কিন্তু তাদের আহাজারি আর কান্নার শব্দ আমার কান পর্যন্ত পৌছাতে পারছে না।
ভাবনাতে কতক্ষণ ডুবে ছিলাম জানি না।
হটাৎ করে কাঁচের জানালার উপর ঠক ঠক আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলাম।
শিলা বৃষ্টি হচ্ছে আর ছোট বড় শিলার টুকরা আমার জানালায় আঘাত করে যেন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বাইরের তান্ডব অনুভব করার জন্য।
ভাবলাম -শুধু পর্দা সরালে চলবে না, কাঁচের পর্দাটাও খুলে ফেলতে হবে। আর দেরী নয় কাল থেকেই শুরু করতে হবে।