প্রেষণা মুলক ছোট গল্প 'প্রাইমারী স্কুল মাস্টার'।

আপডেট: 2022-09-13 12:46:17

প্রাইমারী স্কুল মাষ্টার

 

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’।
প্রথম দিন আমি ক্লাসে ঢুকে পরিচিতি পর্বে বাচ্চাদেরকে কোন একটা কবিতা আবৃতি করতে বলাই, সামনের বেঞ্চে উপবিষ্ট একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছড়াটি গড় গড় করে মুখস্ত বলে গেল।
বাচ্চাদেরকে আমি খুব পছন্দ করি। ওদের মধ্য দিয়েই আমি সভ্যতার ভবিষ্যৎ দেখি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া মেয়েটার আবৃতি আমার মন কাড়ল।
-আচ্ছা বলত কবিতার প্রথম দুই লাইনের অর্থটা কি, মানে কবি কি বুঝাতে চেয়েছেন?
প্রশ্ন শুনে বাচ্চারা সবাই নিরব। বিহ্বলতা ওদের হাসি ভরা মুখের উপর ভর করল। নিজেদের মধ্যেও মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ওরা।
-তোমরা কে কে নদী দেখেছ?
নিরবতা ভেঙ্গে এবার সবাই হাত তুলল।
-নদীটা কি সোজা চলে না একে বেকে চলে।
-একে বেকে চলে। সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো।
-তাহলে এবার বল প্রথম লাইনে কবি কি বুঝাতে চেয়েছে?
সবাই আগের মত বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।

ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগদানের জন্য পরীক্ষা দেব, সব মিলিয়ে বছর দুই তো লাগবেই তাই এই ফাঁকে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রয়াসে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করার এই চাকরীটা করার মনস্ত করেছিলাম।
আমরা সব ভাই বোন শহরে জন্মে সেখানেই মানুষ। তবে বাবার কাছে শুনেছি তিনি গ্রামের স্কুলে পড়ে মানুষ হয়েছেন। তার কাছে শুনেই গ্রামের জন্য কিছু একটা করার মানসিকতা বরাবরই লালণ করি। তাই এই সুযোগটা পেয়ে সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে শহর থেকে দূরে এই পাড়াগায়ের সরকারী প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করতে চলে এলাম।
কিছু দিনের তো ব্যাপার নিজের উপর একটা চ্যালেঞ্জ নিলাম বলা যায়।

প্রথম দিন ক্লাস নিতে যেয়েই ধাক্কাটা খেলাম। প্রাথমিক স্কুল হচ্ছে মানুষ গড়ার প্রথম সোপান আর সেখানেই বাচ্চাদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের রাস্তা বন্ধ! বাচ্চারা কি পড়ছে তা চিন্তা করে না, শুধু মুখস্ত করে। ওরা প্রশ্ন করে না, না বুঝলেও কিছু জানতে চায় না!
আমি আঁকাতে একদম আনাড়ি, তবুও ব্লাক বোর্ডে একটা শীর্ণ একে বেকে বয়ে যাওয়া একটা নদী আঁকলাম। অনেক কষ্ট করে একটা গরু টানা গাড়ী নদী পার হচ্ছে সেটা আঁকার চেষ্টা করলাম।
-দেখ তো তোমরা কিছু বুঝতে পার কিনা?
সবাই হাত তুলল। আমি একজনকে ছবিটা বর্ণনা করতে বললাম।
-স্যার, একটা নদী তার ভিতর দিয়ে একটা গরু গাড়ী পার হয়ে যাচ্ছে।
-খুব ভাল। বলতো নদীটা কি সোজা ভাবে বয়ে যাচ্ছে?
-না স্যার, আঁকাবাঁকা। কয়েকজন একসাথে জবাব দিল।
-আচ্ছা নদীতে পানি কম না বেশী?
-কম স্যার।
-কি করে বুঝলে?
-না হলে গরু গাড়ী পার হয় কি ভাবে? হাসতে হাসতে একজন উত্তর দিল।
-আচ্ছা এবার বল, কোন সময় নদীর পানি কম থাকে।
-শীত কালে। একজন উত্তর দিল।
-ঠিক আছে। তোমরা বাংলা মাসের নাম কে কে জান হাত তোল?
কয়েকজন হাত তুলল।
-আচ্ছা বল বাংলা বছর শুরু হয় কোন মাস দিয়ে?
সবাই চুপ।
-বৈশাখ মাস দিয়ে। কিছুক্ষন পর একজন উত্তর দিল।
-খুব ভাল। তোমার নাম কি?
-ফাতিমা।
-ধন্যবাদ ফাতিমা। এবার বলতো বৈশাখ মাসে কি হয়?
-বৈশাখী ঝড়।
-বাহ। কি নাম তোমার?
-রবি।
-তোমারা সবাই কি ভাল। বৈশাখ মাসের আগে বেশ কয়েক মাস ধরে যেহেতু তেমন কোন বৃষ্টি হয় না তাই নদীতে পানি কম থাকে। তাই না?
-হ্যাঁ স্যার। সবাই সমস্বরে বলল।
-ঠিক আছে, আজ তোমরা সবাই বাড়ী ফিরে কবিতাটা ভাল করে পড়বে, তারপর সাদা পাতাই পেন্সিল দিয়ে কবিতার একটা ছবি আকবে। সাথে বাংলা বারো মাসের নাম লিখে আনবে।
-আচ্ছা স্যার। সব বাচ্চারা সমস্বরে বলে উঠল।
বাচ্চাদের বারবার এভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমস্বরে কথা বলার শব্দ হেড মাষ্টার সাহেব রুম থেকে শুনে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য একবার এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন।
আমি ক্লাস শেষে হেড মাষ্টারের রুমে গেলাম। সেখানে অন্যান্য শিক্ষকরাও বসে ছিলেন।
হেড মাষ্টার সাহেব আমার বায়োডাটা থেকে আমার লেখাপড়া সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য সবাইকে জানিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
-উনি এত ভাল রেজাল্ট করা শহরের একজন মানুষ। সময় কাটাতে এসেছেন মনে হয়, দেখা যাক কদিন থাকেন। উনি তো চাকরীটা সংসার চালানোর জন্য তো করছেন না।
একজন শিক্ষকের মন্তব্যে পরিষ্কার ভাবে উপস্থিত সবাই তার কথাই সাই দিলেন।
-দেখুন আমি গ্রামের না শহরের ছেলে, এই বেতন দিয়ে আমি সংসার চালাব কিনা বা আমি এখানে কতদিন থাকব ইত্যাদি বিষয়গুলো শিক্ষকতার জন্য অপ্রাসঙ্গিক।
আমার মন্তব্যে সবাই তাকাল আমার দিকে।
-আমাদের দেশের আশি থেকে নব্বই ভাগ নাগরিক গ্রামের এই সব স্কুল থেকে তৈরী হয়। শহরে কটা মানুষই বা বাস করে? শতকরা পনেরো বা বিশ জন। আর শহর বাসীর মধ্যে বড় একটা সংখ্যক মানুষ শ্রমজীবী। তারা খুব মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ভাল স্কুল নেই। তাই শহরের কথা বাদ দিয়ে গ্রামে আপনাদের মত স্কুলের কথাই বলি।
সবাই চুপ করে বসে যেন একদম নতুন কিছু শুনছে।
-গ্রামের এসব স্কুল থেকেই দেশের নব্বই ভাগ সুনাগরিক তৈরী হয়। আর আপনারা, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকরা দেশের সুনাগরিক গড়ার এক একজন নিপুন কারিগর। আপনারা হেরে গেলে দেশ হেরে যাবে।
হেড মাষ্টারের রুমে পিন পতন নীরবতা।
-কিন্তু আপনি তো জানেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে যে বেতন দেয়া হয় তা দিয়ে কোন রকমেই সংসার চলে না। আমাদের সবাইকেই অন্যান্য কাজ করতে হয়, যেমন কেউ বা নিজের ক্ষেতে কাজ করি, কেউ বা একাধিক টিউশানি ইত্যাদি করে বাড়তি ইনকাম করি জীবন চালাতে।
-আর, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের সমাজে কি কোন ইজ্জত আছে!
একজন শিক্ষকের করা মন্তব্যের সমর্থনে অন্য আরেকজন শিক্ষক যোগ করল।
-আচ্ছা বলুনতো এতকিছু করার পরও কি আপনাদের সংসার ভাল ভাবে চলে?
-না চলে না। বেতন ভাতার জন্য আমাদেরকে রাস্তায় শুয়ে অনশন পর্যন্ত করতে হয়।
আমার প্রশ্নের জবাবে একজন শিক্ষক কিছুটা তিক্ত কন্ঠে উত্তর দিল।
-তাহলে কি দাড়াল? ভাল বেতন বা সমাজে মর্যাদা না পাওয়ার জন্য আপনারা সব সময় অতৃপ্ত হৃদয়ে থাকেন, ফলশ্রুতিতে আপনারা আপনাদের পুরোটা দিয়ে বাচ্চাদের পাঠদান করেন না, আর বাচ্চারাও বিকশিত হতে পারে না।
-মানছি আপনার কথা। তাহলে আমাদের কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
একজন শিক্ষক বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
-আপনারা সবাই আপনাদের ছাত্র ছাত্রীদেরকে আপনাদের সাধ্যানুযায়ী পাঠদান করে তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তূলতে পারলে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত ভাবে আপনাদের ছাত্র ছাত্রীরা উপকৃত হবে তেমনি সমষ্টিগত ভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি হবে। আর আপনাদের হাতে গড়া ছেলেমেয়েরাই একদিন আপনাদের মূল্যায়ন করবে।
শিক্ষকদের কেউ কোন মন্তব্য করল না।
-আমি শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। আমি সব পরীক্ষাই ডিস্টিংশান সহ উত্তীর্ণ হয়েছি। কলেজ ইউনিভার্সিটির অনেক শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শিখেছি কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেই সালাম করি।
কেউ কোন কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল।
-আপনাদের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্য থেকে যখন কেউ একজন দেশের মন্ত্রী হবে, একজন শিক্ষাবিদ বা একজন বড় কোন কর্মকর্তা হবে তখন আপনাদের সাথে দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছু কি কেউ আশা করেন কি!
সবাই চুপচাপ বসে কথা শুনছে।
-আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, যে কয়দিন বা মাস বা বছর এখানে থাকি না কেন, নিজেকে দেশের সুনাগরিক গড়ার কারিগর মনে করে পাঠ দান করবো।
-তুমি ঠিকই বলেছ খালিদ। তুমি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছ। এতক্ষণ পর হেড মাষ্টার সাহেব মন্তব্য করলেন।
-আপনার মত তো আমরা অত লেখাপড়া জানি না, আপনি যেটা বলছেন সেটা কি আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে? একজন মধ্য বয়সী শিক্ষক মন্তব্য করলেন।
-আপনাদের সরলতাই আমি সত্যিই মুগ্ধ। এই কচি কচি ছেলে মেয়েদের পাঠদানের জন্য কোন পান্ডিত্বের দরকার নেই, দরকার আপনাদের কাজের প্রতি ভক্তি আর একনিষ্ঠটা। আপনারা শুধু বাচ্চাদের মনে চিন্তার জড়তা খুলে দেয়াতে সহায়তা করবেন। ওদের যা মনে আসে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করবেন। প্রশ্ন করলে চিন্তা চেতনার নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যায়। প্রশ্নের উত্তর যেটা আপনাদের জানা আছে সেটা দিবেন জানা না থাকলে পরে জানাবেন।
শিক্ষকরা সবাই খুব অনুপ্রাণিত বোধ করে আমার কথার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে লাগলো।
আমি আমার আজকের ক্লাসের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম।
পরদিন থেকে স্কুলের চেহারাই যেন আমুল পরিবর্তন দেখা দিল।
স্বতঃস্ফূর্ততার একটা অনন্য রুপ আছে।

প্রায় মাস ছয়েক পর যেদিন ফাতিমা আমাকে জিজ্ঞেস করল- স্যার আপনার নাম খালিদ কেন রাখা হয়েছিল? সেদিন আমি তাকে খালিদ বিন ওয়ালিদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলাম সাথে ফাতিমা নামের তাৎপর্যও সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।
আর সেদিনই বুঝলাম এখানে আমার কাজ শেষ হয়ে আসছে। এবারে যাবার সময় হয়েছে।