জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১০।।

আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২২, ১৪:২১

অম্বরাবনী-১০ 

ওরকম ভাবে ছেলে মেয়েরা মিলে বাবা মায়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করা ভিডিও দেখার কয়েকদিন পর মিগেলের সাথে দেখা হলে অন্যান্য কথার মধ্যে ওর বাবা মায়ের বিয়ের ব্যপারটা জিজ্ঞেস করল অবনী।
প্রথমে ও একটু অবাক হলো। তারপর যা বললো তাতে অবনী শুধু অবাকই না হৃতবাক হয়ে রইলো। আজ অবনী আরো পরিস্কার করে বুঝলো যে শুধু তার কলিগদের কাছেই না এদের সবার কাছেই সে এক অন্য জগতের মানুষ।

পর্তুগাল থেকে আসা শেতাংগদের অনেকেই তাদের পছন্দমত এদেশীয় নারীদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সহবস্থান করতো। এমনি ভাবেই ঐ শেতাংগ পর্তুগীজ এই বাড়ীর বর্তমান মলিক ম্যারিয়েটের সাথে একত্রে বসবাস শুরূ করে। এ ভাবেই ওদের চার ভাই বোনের জন্ম। তারপর তিনি যুদ্ধের মুখে তাড়াহুড়া করে এদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বিয়েটা সম্পন্ন করেন। তাই ততোদিনে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গিয়েছে আর মজা করে বাবা মায়ের বিয়েতে নাচানাচি করছে।
অবনী বুঝলো মানুষ হিসেবে ব্যাহ্যিক দৃষ্টিতে এদের সাথে মিল থাকলেও সে কখনোই এদের একজন হতে পারবে না। এখানে এভাবে একাকী হয়েই ওকে বাচতে হবে।
এই কোলহলের মধ্যেও অবনী একদম একা। কথা বলার মত, শোনার মত বা ওকে বোঝার মত কেউ এখানে নেই। অফিসের কাজের কথাগুলো ছাড়া ওর কথা, ওর সুখ দুঃখের ভাষা এখানে কেউ বুঝবে না।
এই কি চেয়েছিল ও জীবনের কাছে! এত সংগ্রাম এত কষ্ট করে এই অর্জন সত্যিই কি সে চেয়েছিল!
নিজের চেষ্টায় আর প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষার জোরে ও নিজের পরিবার বন্ধু আত্মীয় এমনকি দেশ ছেড়েছে। যা কিছু চেনা জানা তার থেকে ও দূরে আসতেই চেয়েছিল। কিন্তু সে দূরত্ব যে এতদূর তা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
ওর মানষপটে ভেসে উঠছে ওর ভাই বোন পাড়া প্রতিবেশী আর দেশের মানুষের কথা। বেশ আছে ওরা নিজের নিজের জায়গায়। নিজ নিজ জায়গাতে ওরা সবাই আশেপাশের অন্য সবার মত, অবনীর মত একাকী নয়।
অবনী হচ্ছে সীমাহীন প্রাথমিক জংগলের মাঝে গজিয়ে ওঠা বিজাতীয় এক বৃক্ষ। অন্যান্য সব বৃক্ষের জন্ম ওখানেই আর গোড়া থেকেই ওখানেই বসবাস।
একই মাটি আর আবহাওয়াই বড় হয়ে গোড়াটা যেমন সবার একই রকম মোটা আগাটাও একই রকম লম্বা। কোন ঝড় ঝাপটা আসলে সবার গায়ে সমান ভাবে লাগে, কারণ তা সবাই ভাগাভাগি করে নেয়। সমজাতীয়দের মধ্যে থাকার বোধহয় ওটা একটা আর্শিবাদ।
কিন্তু অবনীর বসবাস ভীনদেশে। ওদের সবার সাথে তাল মিলাতে চারপাশের মোটা মোটা হৃষ্ট পুষ্ট লম্বা লম্বা গাছের ভিতর কোনরকমে নিঃশ্বাস নিয়ে বেচে থাকে সুর্যের আলোর মুখ দেখতে ওদের গোড়ার মত মোটা না হতে পারলেও লম্বাই ওদের সাথে তাল মিলাতে হয়েছে। আর মূল সমস্যাটার সৃষ্টি ওখানেই, মূলের পার্থক্য। তায় যখন কোন ঝড় বয়ে যায় তখন ঝড়ের ঝাপটাটা ঐ গোড়া দুর্বল আগাই সমান গাছটার উপরই পড়ে, ওকে একাই সইতে হয় সে ঝাপটার রোষ। কারণ তার ভাগ নেয়ার কেউ নেই।
নিজের অবস্থাটা যাচায় করা একটা আপেক্ষিক ব্যপার। কেবল তুলনা করলেই বোঝা যায় কেউ নিজে ভাল আছে না খারাপ। আর তুলনাটা সবসময়ই করা হয় আশেপাশের সব কিছুর সাথে। তায়তো বিধাতার সৃষ্টিতে আর তাঁর অমোঘ নিয়মে প্রাণীকূল সবাই নিজ নিজ জাতি প্রজতির সাথেই অবস্থান করে।
প্রকৃতিও বোধহয় এমনটিই চায়।
এখানে অবনীর অবস্থা হলো অনেকটা আলফ্রেড টেনিসনের কবিতার ট্রয় নগরীর টিথোনাসের মত। স্বর্গের সুন্দরী এওস মর্তের মরনশীল প্রেমিক টিথোনাসের প্রেমে পড়ে তার জন্য ভগবানের কাছ থেকে অমরত্বের বর আনলেও চির যৌবনার বর না আনাতে বয়োবৃদ্ধির কারণে টিথোনাসের করুন অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

স্বর্গের দেবী ওকে ভালোবেসে আকাশে নিয়ে গেল যেখানে সব অমৃত দেব দেবীদের বাস। টিথোনাস অমরত্ব ঠিকই লাভ করলো, কিন্তু প্রেমে আসক্ত দেবীর চাওয়ার ভূলের জন্য বিধাতা তাকে অমর যৌবন দিল না। মর্তবাসী টিথোনাস সময়ের অমোঘ নিয়মে সব যৌবন হারিয়ে রোগাক্লিষ্ঠ কংকাল সার হয়ে গেল। কিন্তু মৃত্যু ওকে চিরমুক্তি দিতে আসে না কারণ ওযে অমরত্বের বর প্রাপ্ত। আর মৃত্যুর যমদূততো আকাশে আসে না, কারণ এটা যে অমৃতদের বসবাসের স্থান অন্য কারো এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু টিথোনাস যে মরনশীলদের একজন।
নিজের সবার থেকে যোজন যোজন দূরে আকাশে বসে সে দেখতে পায় যে কি সুন্দর অমোঘ মর্তের নিয়মে মৃত্যু ক্ষনে ক্ষনে মানুষকে সব জ্বরা জীর্ণতা, কষ্ট থেকে মুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু ওর কোন মুক্তি নেই। তার অপরাধ -ও যেখানে বসবাস করছে ওতো সেখানকার কেউনা।

ঠিক তেমনি, এ গ্রহের আঈনসিদ্ধ বাসিন্দা হলেও অবনী অন্য গ্রহের মানুষ।
অবনী ওর নিজের কোন কথাই এদেরকে বলতে পারে না। কারণ ওগুলো এদের জীবনধারা এদের মুল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অফিস শেষ হলে ও আর অম্বর ছাড়া আর কেউ থাকে না ওদের মাঝে। এখানে ঐ একটা জিনিস অন্ততঃ ভাল হয়েছে। অম্বরকে একদম একাকী একদম কাছে পাওয়া যায়।
কিন্তু অম্বর ঐ আগের মতই অন্যমনষ্ক, যেন আজন্ম অতৃপ্তিতে ভরা ওর মন। এত ব্যস্ততা এত সব পরিকল্পনা এসব যেন ওর পছন্দ না।
এমন হওয়ার কারণ কি! ওর এত সব অর্জন, ওর আজন্ম কষ্টের থেকে পরিত্রান, এসব কিছুতে অম্বরতো যার পর নেই খুশী হয়েছিল। তাহলে!
কোন প্রশ্নের জবাবই অবনী মিলাতে পারে না।
ওর সব কিছুইতো অম্বরকে ঘিরেই। অবনী যা কিছু করে তাতো একমাত্র অম্বরকে খুশী করার জন্যই।
অম্বর চিরকালই অভিমানী আত্মকেন্দ্রিক। ওর নিজের জগতেই থাকে। কিন্তু অবনীর প্রতি ওর ভালবাসাটা যে গভীর আর অকৃত্তিম সে বিষয়ে অবনীর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সুখে দুখে সব সময় অম্বর ওর সাথে থাকে। কোন কারণে সবাই ওকে ত্যাগ করলেও অম্বরের সান্নিধ্য ওর সাথে যেন অটুট ভাবে বাধা।
অম্বরের উপর ওর অধিকারটা এত গভীর যে ওর সব অনুভূতি, সব ভাল লাগা না লাগা অবনী বুঝতে পারে। অম্বরের চাহিদার ব্যপারে অবনীর একচ্ছত্র অধীকার।
অম্বরের প্রতি ওর ভালবাসাটা এত প্রবল যে অবনী প্রকৃতপক্ষে অম্বরের আলাদা অস্তিতের কথাটা ভুলেই যায়। অম্বরের অবস্থান অবনীর দেহে মনে, ওর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে ওর চিন্তা চেতনায়।
সম্পর্কের শুরূটা যে ঠিক কি ভাবে বা কবে থেকে তার একটুও মনে নেই ওর। অম্বর আর অবনী একে অপরের সাথে মিশে একাকার হয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে ওরা অন্যান্য সবার মত।
ওরা একে অন্যের জন্য সৃষ্টি, তায় জীবনটা এক সাথেই চলতে হবে ওদের। অম্বরকে নিয়েই অবনীর যত সপ্ন যত সাধ। অম্বরের ভালোলাগাই অবনীর সব প্রচেষ্টার শ্রেষ্ট পুরষ্কার। অম্বরকে ঘিরেই অবনীর সব পরিকল্পনা আবর্তিত হয়।
বংশ পরিচয়ে অম্বরের সাথে অবনীর তফাৎ আকাশ আর মাটির। অম্বর ও রকম একটা উচ্চ স্থান থেকে নেমে অবনীর মত একটা সাধারণ মাটির ঘরে আসার কারণেই হোক, বা অম্বরের অসীমতার কারণেই হোক, ওকে খুশী রাখায় যেন অবনীর একমাত্র লক্ষ।
বলতে গেলে পাগলের মত, খ্যাপার মত মত ভালবাসে ওকে। অম্বরের প্রতি ওর ভালবাসাটা একেবারে অন্ধ। অম্বরকে কিছু চায়তে হয় না, বলা যায় চাওয়ার সুযোগ ওকে দেয় না। ওকে দেয়ার ইচ্ছাটা অবনীর এত প্রবল যে, অম্বর যে কি চায় তা শোনার মত ধৌর্য্য আর সময় অবনীর কোথায়। অম্বরের প্রতি ভালবাসাটা এত গভীর যে অবনী নিশ্চিত অম্বরের সব আকাঙ্ক্ষা ওর জানা।
অম্বর চিরকালই আলাপবিমুখ এক প্রহেলিকা। সে তার বংশগুনের জন্যই হোক বা অন্য অজানা কারণে। কিন্তু অবনীর প্রতি ওর ভালবাসাটা গভীর, তা নাহলে অবনীর ঐ ভালবাসার উন্মাদনায় দৃশ্যতঃ অম্বর কখনো কোন বাধ সাদে না।
অবনীর জীবনের গল্প পুরোটায় অম্বরকে নিয়ে।
অবনীর সাথে অম্বরের সম্পর্কটা প্রতিটি মানুষের সাথে বাতাসের সম্পর্কের মত।
কোন মানুষই নিঃশ্বাস ছাড়া বাচতে পারে না। ঘুমে জাগরনে সুখে দুখে সব সময়ই নিঃশ্বাস নিতেই হয়। কিন্তু মানুষ কি ভেবে ভেবে নিঃশ্বাস নেয়! এটা একটা স্বপ্রনোদিত ব্যাপার। নিঃশ্বাস নেয়াটা প্রতিটি প্রাণের জন্মগত অধিকার। এই অধিকারটা ভোগ করতে কেউই কোন চিন্তা ভাবনা করে না। তায় বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকেও বাতাসের অস্তিত্বই মানুষ ভুলে যায়। যদি কখনো বাতাসের অভাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখনই কেবল বাতাসের অস্তিত্বের কথা মনে হয়।
এখানে অসার পর অবনী নিজেকে গুটাতে গুটাতে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে শুধু যেন অম্বরের সাথে ওর সব হিসাব মিলাতে চায়।
কিন্তু অম্বরের মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই। তবে এ নিয়ে অবনীর কোন দুশ্চিন্তা হয় না।

অবনী নিজের তৈরী একজন মানুষ। আজকের এ সব কিছু যেহেতু ওর নিজেরই শ্রম আর আকাঙ্ক্ষার ফসল। তায় সব ভাবনাকে দূরে ঠেলে এখানকার সবকিছুর সাথে মিশে এদেরই একজন হয়ে মিশে থাকার মনোস্থির করলো অবনী।
এসব নিয়ে অনেক ভেবেছে অবনী। কিন্তু ফেরার আর কোন পথ নেই। জীবনটা যেন মানিয়ে চলা, অম্বরের সাথে আর অন্যান্য সবকিছুর সাথে।
আকাশের বুকে বাতাসের গতিতে গা ভাষিয়ে মর্তের কাগজে গড়া ঘুড়ী যেমন নিজেকে ভাসিয়ে দেয় ঠিক তেমনি।
ওদের আচার আচরন মুল্যবোধ সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে অবনী ওর জীবনকে পরিচালিত করার মনোস্ত করলো। বিধাতার সাথে এ যেন ওর মহাব্রত।
এ যেন বর্ষার পানির স্রোতের মত। চলতে ওকে হবেই সমুদ্রের টানে যতদিন তার দেখা না মেলে। বাধা পেলে তা সরিয়ে ফেলার স্বপ্রনোদিত প্রয়াসে তার কিছুটা সরিয়ে বা নিজের গতিধারা কিছুটা পরিবর্তন করে হলেও চলতে হবে ওকে।