সকল সম্মানিত পাঠকদের নব বর্ষের শুভেচ্ছা। জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১৫।

আপডেট: ০১ জানুয়ারী ২০২৩, ১৫:৩১

অম্বরাবনী-১৫ 

কি করবে এখন অবনী? ভেবে তার কিছুই কুল কিনারা করতে পারলো না।
জীবনের হিসেবটা পুনরায় একদম গোড়া থেকে করতে মন চায়লো।
এত শ্রম, ব্যথা ঢাকার এতসব প্রয়াস, এ সবের ফল কি বুকের মধ্যে এই শুন্যতা আর হাহাকার! কার জন্য, আর কি জন্য এতসব!
প্রতিটি জীবন যেন এক একটা বন্দিশালা। শাস্তি-অশান্তি, সুখ দুঃখ, খারাপ ভালো সব পরিস্থিতিতেই কেবল চলতে হবে। চলায় যেন জীবনের একমাত্র ব্রত।

অবনী তখন ছোট, বোধহয় ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ে। অংকের বৃদ্ধ শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি বলতেন -অংক মানেই সব হিসেবের ব্যপার, কোন এক জায়গায় একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাস। অংকের কোথাও ছোট্ট একটা ভূল, সুদে আসলে অক্টোপাশের মত হয়ে গোটা হিসেবটাই এলোমেলো করে দেবে। তাই তিনি ক্লাসে বসা ছেলেমেয়েদের একটু অন্যমনষ্কতাকেও প্রশ্রয় দিতেন না।

সেদিন ক্লাসের সময় বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টির স্যাঁ স্যাঁ শব্দ অবনীকে ওদিকেই টানছিলো। অবনী মাঝে মধ্যে সুযোগ বুঝে তা দেখছিলো। হটাৎ করেই শিলা বৃষ্টি পড়তে শুরূ করলো। শিলা বৃষ্টি অবনীর দারূন পছন্দ। আকাশ থেকে সাদা সাদা বরফের দানা পড়ে পাশের সবুজ মাঠটা সাদা হয়ে যাচ্ছে।
আহ কি দারূন দৃশ্য! সাদা সাদা শিলার দানার ব্যপারে অবনীর মনে একটা অদ্ভুত ধারণা আছে। ওর মনে হয় ওগুলো পূত পবিত্র, বিধাতার ছোয়া আছে ওগুলোতে। শিলা বৃষ্টি উপভোগ করা থেকে ও নিজেকে কখনো বিরত রাখেনি। কিন্তু এই মুহুর্তে অংকের হিসোবের দোহায় দিয়ে ওর শিক্ষক ওকে আটকে রেখেছে।
বাইরে যাওয়ার জন্য অবনীর মনটা খুব আনচান করতে লাগলো। কিন্তু অংকের টিচার কিছুতেই ক্লাস বন্দ করলেন না। বরং অবনী বার বার বাইরে তাকানোর অপরাধে শস্তি স্বরূপ জানালার ধার থেকে ওর সিট পরিবর্তন করে দেয়ালের ধারে বসালেন যাতে বাইরেটা একদম দেখা না যায়।
ঐ প্রথম অবনীর মনের ভিতর একটা অদ্ভুত ধারণার জন্ম নিল। ওর মনে হলো ও একটা জেল খানার মধ্যে বন্দি। স্কুল, এই সব পড়াশোনা নিয়মকানুনের কাছে ও বন্দি।
বন্দিদশার মধ্যেই ওর জীবন এগিয়ে চললো। এক এক করে যত উপরের ক্লাসে উঠলো, যত দায়ীত্ব বাড়লো ততোই নতুন নতুন নিয়মকানুনের আওতায় এক জেল থেকে অন্য জেলে জীবনটা স্থানান্তরিত হতে লাগলো।
ক্রমে ক্রমে জীবনটা কেবল জেল থেকে জেলে যাওয়া মনে হতো অবনীর।
জেলখানার পরিধি আরো ছোট হতে লাগলো যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার সুবাদে, হায়ার সেকেন্ডারিতে আরো ভাল করার প্রত্যয় জন্মাল ওর মনে। অবনী নিজেকে সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে পড়াশোনার মধ্যেই আরো বেশী করে গন্ডিবদ্ধ করলো। নিজের অজান্তে কি এক অজানা নেশায় নিজেই নিজের চারিপাশের জেলের প্রাচির গুলো আরো যেন গুটিয়ে নিল।
নেশার বোধহয় এটাই মজা -নেশায় থাকলে নিজেকে হারিয়ে রাখা যায়। অন্য সব কিছু ভুলে থাকা যায়।
কিন্তু নেশার ঘোর কাটলেই মুষ্কিল, আবার সেই জীবনের বাস্তবতা।
ম্যট্রিক পরীক্ষায় অভাবনীয় ফলাফলই নিজেকে শৃংখলাবদ্ধ করার নেশায় ওকে পেয়ে বসলো। তারপর সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশার ঘোরে কালে কালে অবনী একদিন সবাইকে ছেড়েই চলে এলো।
নেশার ঘোরেই ও নিজেকে একদম বদলে ফেলে জেলের পরিধিটাকে সংকীর্ণ করতে করতে নিজেকে দ্বীপবাসী করে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসলো।
এখানে কোন স্বাধীনতা নেই ওর। ওর ইচ্ছায় কিছুই হয়না এখানে। জীবনের সব কিছুই একটা হিসেবের পরিধিতে বাধা।
অবনী এক জেলখানার বাসিন্দা। একেবারে স্থায়ী বাসিন্দা। ও নিজেই ধীরে ধীরে নিজ হাতে তীল তীল করে তৈরী করেছে জেলটা।
এ জেল থেকে বেরূনোর কোন কি পথ নেই!
সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে অবনী কাজের মধ্যে, মানুষ সেবার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চায়লো।
যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশটাতে সবে মাত্র শান্তির ক্ষীণ শিখা উঁকি দিতে শুরূ করেছে। এখানকার মানুষের কত দিনের স্বপ্ন বাস্তবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিবাদমান দুপক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। এত সব যেন কোন কারণেই ব্যহত না হয় তার জন্য সবাই তৎপর।
শান্তি কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শান্তি রক্ষি বাহিনী যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হচ্ছে। তাদের বাসস্থান সহ অন্যান্য যাবতীয় সব কিছু যোগানোর জন্য রাত দিন সবাই নেশার মত কাজ করছে।
এমনি সময় অবনীর বাবা মারা গেলেন।
সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আফ্রিকার এই দেশে অবনী মানুষের সেবামূলক কাজে নিবেদিত। মানুষের সেবার মধ্যে ডুবে আছে অবনী। ওর দিকে তাকিয়ে আছে যন্ত্রনায় কাতর সহস্র অসহায় মুখ। আড়াই দশক ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা বঞ্চনার পঞ্জিভুত ভাবাবেগ বাধ ভেঙ্গেছে মাত্র। দেশ বিদেশ পাহাড় জংগলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত সহস্র মানুষ ঘরে ফিরছে। এতদিন জমে থাকা সব ব্যথা বেদনা উপশম করতে চাপা বেদনাগুলো হিংস্র জানোয়ারের মত গোঁ গোঁ করতে করতে বাধ ভাঙ্গা জলের মত সব বাধা ভেঙ্গে চুরে এগিয়ে চলেছে। কার সাধ্যি তা রুখে দেয়ার!
রূখতেও চায় না অবনী সে জোয়ার, বরং সে তার অংশ হতে চায়।
কিন্তু ওর বুকের গহীনে জমে থাকা জোয়ার কি করে রূখবে সে। ওর জন্মদাতা বাবা এ দুনিয়াতে আর নেই।
অবনীর সাথে যারা এখানে কাজ করে, তাদের কাছে বাবা মারা যাওয়া খবরের কাগজে ছাপা কোন বিজ্ঞপ্তি পড়ার মত। অবনী ওদের একজন হলেও সে যে ওদের থেকে আলাদা সে কথা ওর থেকে ভালো আর কে বুঝবে।
সব থেকে দ্রুততম যানে গমন করলেও এখান থেকে তিন দিন লাগবে বাড়ী ফিরতে। এ কি ধরনের জেলের বাসিন্দা অবনী!
ভাবতে দমটা বন্দ হওয়ার উপক্রম হলো। ইচ্ছা হলো পালিয়ে বাচতে। মনে হতে লাগলো-আহ এই মুহুর্তে যদি ওর নিজের অস্থি আর মাংসের শরীর থেকে বেরিয়ে পাথীর মত মুক্ত আকাশে উড়ে যদি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারতো।
অবনীর মনে হলো- আর না এ বাধন ভাঙ্গতেই হবে। নিজের হাতে গড়া জেলখানা থেকে মুক্তি পেতেই হবে।
অনেক অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা চোখের সামনে ভাসলো। যে জীবনটা ছেড়ে ও চলে এসেছে সে জীবনের বিভিন্ন প্রতিকুলতার কথা চিন্তা করে চমকে উঠলো অবনী নিজে থেকেই।
কি করবে এখন ও! বিশ্বমানবতার সেবায় নিজেকে বিসর্জন দিয়ে বিশ্ব নাগরিকের মর্যাদায় পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে মিষ্টার লিভিংষ্টোনের মত অক্ষয় মর্মর মূর্তি হয়ে থাকবে!
কিন্তু তারও কোন নিশ্চয়তা আছে কি!
বিশ্ব নিয়ন্তা বোধহয় সবাইকে একটা সীমায় বেধে একটা নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারন করে দিয়েছে। তার বাইরে যাওয়ার সাধ্য কার।
অবনী নিজের ব্যপারে সম্পুর্ণ অযাচিত ভাবে কিছু দায়িত্ব গ্রহন করে বিশ্বনিয়ন্তা কতৃক বেধে দেয়া গন্ডির অনেক বাইরে চলে এসেছে। কিন্তু ফিরে ওকে যেতে হবেই। কারণ এ যে বিধাতার নিয়ম।
আসার রাস্তা ও নিজেই বের করেছে, কিন্তু ফেরার রাস্তাতো সে জানে না!
জীবনের এই সন্ধিক্ষনে দাড়িয়ে অবনীর সবচেয়ে দরকার একটু আদরের পরশ। কিন্তু সে বিষয়ে বোধহয় ওর ভাগ্যবিধাতা একেবারে বিরূপ।
সারা জীবন ধরে অম্বরের সুখের জন্য ও না চায়তেই সব ওকে দিয়েছে। কিন্তু আজ যখন ওর কাছ থেকে একটু আশার বাণী শোনার জন্য অবনী কাতর, তখন অম্বর একটুও মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে না বরং অম্বরের কান্নার সুরটা ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে জোরালো হয়ে উঠছে।
কি করবে অবনী! কাকে দোষ দিয়ে মনটা একটু হালকা করবে।
নিজের লজ্জা নিজের কষ্টকে ঢাকার জন্য যা কিছু করেছে তার সবই কি ভূল! তাহলে কি করতে পারতো ও! কি করা উচিত ছিল!
অবনী বসে আছে, ক্লান্ত শ্রান্ত।
সালভাদোর, ওর কাজের ছেলেটা চলে যাবে। আজ শুত্রবার তায় দুপুরেরর পর পরই চলে যাবে। নামপুলার আধাপেটা রোগাক্লিষ্ট মানুষগুলোর মত সেও সপ্তাহান্তে সন্ধ্যায় মিউজিকের তালে ডুবে যাওয়ার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
ওর সংসারে ওর ছোট ছোট দুটো ছেলে, মা আর বড় দুটো বোন। বাবা একজনের গাড়ী চালায়। অন্য একটা বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে।
ওর মা কি এক অজানা রোগে ভুগছে। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। টাকা পয়সা অভাবে ডাক্তার দেখানো হয়নি বলে রোগটাও কেউ জানে না। সবাই মেনে নিয়েছে যে এভাবেই ও মারা যাবে।
কোন প্রতিকার করার সামর্থ যেহেতু নেই তাই রোগটার নাম জেনে মরার আগে প্রতিনিয়ত না মরে একবার মরাই বোধহয় ভালো।
সালভাদোরকে অবনী বিশ ডলার মাসিক বেতন দেয়। তা দিয়েই ওদের সংসার চলে। ওর বড় বোন দুটো কিছু দিন আগ পর্যন্তও কাজ করতো কোন একটা দোকানে। সেখানে দোকানের দুজন কর্মচারীর সাথে ওদের সম্পর্কের দরূন দুবোনই বাচ্চা প্রসব করেছে। ওদের ভালবাসার মানুষ দুটো বেকার হওয়াই বিয়ে করতে পারছে না। তবে মাঝে মাঝে ভালবাসার টানে কিছু খরচ পাঠায়।
এবয়সী অবিবাহিত বাচ্চা পিঠে ঘোরা মেয়েদের দৃশ্য নামপুলার রাস্তায় চোখ উঠিয়ে তাকানোর মত কোন বিষয় নয়। তবে বিষয়টা হলো ওদের বাচ্চাদুটো বড় না হওয়া পর্যন্ত সালভাদোরের ইনকামের উপরই ওদের সংসার চলতে হবে।

অদুরে যে পাহাড় গুলো দেখা যায় ওখানেই মাটির একটা ঘরে ওরা বাস করে।
কোন ভবিষ্যৎ নেই ওদের সামনে তাই কোন চিন্তাও নেই ভবিষ্যতের। অন্তরের কোন অনুযোগ ওদেরকে যেমন ব্যথিত করে না, বাইরের কোন তাড়নাও তেমনি ওদের জীবনকে থমকে দেয় না। বিধাতার দেয়া চোখ দুটো দিয়ে যতদুর দেখা যায় ওদের পৃথিবীর সীমা অতটুকুই।

সালভাদোর একদিন ওর হাতের কাজ সারতে সারতে রাত হয়ে যাওয়াই বাড়ীতে না গিয়ে অবনীর বাসাতে থেকে গেল।
পরদিন ভোরে ওর মা আর বোনদের কান্নাকাটির শব্দে অবনীর ঘুম ভাঙলো। জানালা দিয়ে উঁকি দেতেই দেখল সালভাদোরের হাড্ডিসার মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে, পাশে ওর বউ আর ছেলে দুটো দাড়িয়ে আর বোন দুটো ওদের ছোট্ট বাচ্চা কোলে সুর করে কাঁদছে।
কি অপরূপ স্বর্গীয় দৃশ্য! সালভাদোর ওর আপন মানুষগুলোর মাঝে এক স্বর্গীয় তৃপ্তিতে বসে আছে।
অবনী এই মুহুর্তে ওর কাজের ছেলে সালভাদোর যার কোন শিক্ষা দিক্ষা নেই, সহায় সম্পত্তি নেই, নেই কোন অতীত ভবিষ্যৎ, তার সাথে নিজেকে তুলনা করতে আর ওর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে খুব মন চায়লো।