জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'আপন জন'।।

আপডেট: ১০ জানুয়ারী ২০২৩, ১১:০৬

আপন জন

 

সকাল বেলা, ডোর বেলের শব্দে দরজাটা খুলতেই দেখি পুরু লেন্সের চশমা পরিহিত অশীতিপর একজন বৃদ্ধ ক্লান্ত শরীরে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পাশে নামিয়ে রাখা ভারী পোটলাটা হাতে তুলে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে আমার ফ্লাটের ভিতর ঢুকে পড়ল।
আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধ হাতের লাঠিটা সোফার পাশে হেলান দিয়ে ধপ করে সোফাই ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েই চোখ বুজলেন।

-কে আসলো এ অসময়ে?
আমার স্ত্রী রান্না ঘর থেকে নাস্তা বানাতে বানাতে উঁচু গলাই জিজ্ঞেস করল।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে একটু দেরীতে উঠে হাত মুখ ধুয়ে সোফাই বসে টিভিটা খুলে বসবো বলে ভাবছি তখনি বেলটা বাজল।
আমার স্ত্রীর মত আমিও অবাক। ছেলে মেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে, ওরা সেখানেই বিয়ে করে সংসার পেতেছে, তাই আপন বলতে যাদেরকে বুঝাই তারা কেউই দেশে থাকে না। আমাদের ভাই বোনেরা অবশ্য আছে তবে এই বার্ধক্যে এসে সবাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে নিয়েই থাকে। মাঝে মধ্যে কোন আত্মীয় স্বজন যে আসে না তেমনটি নয়, তবে এই মোবাইলের যুগে আগাম কথা বলে তারপর আসে।
তাইতো অবাক হয়েই দরজা খুলেছিলাম। কিন্তু দরজা খোলার পর যখন দেখলাম বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া অপরিচিত একজন বৃদ্ধ, তারপর অমনি ভাবে বিনা দ্বিধায় ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়বে তাতে বাস্তবিকই অবাক হয়ে গেলাম।
তিন দিকে সোফা পাতা প্রশস্ত ড্রয়িং রুমের ভিতর সোফায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্দ করে বসে থাকা বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বয়সের ভারতো আছেই তার উপর দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি আর রাতের অনিদ্রার বাড়তি প্রভাব তার সারা শরীরে প্রতিভাত।
বুঝলাম তিনি গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তিনি কে, কেন আমার এখানে এসেছেন সে সব কথা জিজ্ঞেস করার কোন ফুসরতই পেলাম না।
রান্না ঘর থেকে আমার স্ত্রী কখন এসে আমার পিছনে দাড়িয়েছে খেয়াল করিনি। সেও একই ভাবে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখছে।
ওর উপস্থিতি টের পেয়ে তার দিকে ফিরতেই আমার স্ত্রী ঈশারাই কোন শব্দ না করার জন্য আমাকে তাগাদা দিল।
শীতের সময়, আর শীতও পড়েছে বেশ জাকিয়ে। বৃদ্ধের সারা গায়ে চাদর পেচিয়ে গলা কান সব মাফলার দিয়ে জড়ানো। নম্বাটে চেহারা, চশমার ফ্রেমটা উচু নাক জড়িয়ে বসে আছে। চোখ দুটো বন্দ। ঘুম ক্লান্ত শরীরের জন্য এ এক মহৌষধ।
ইতি মধ্যেই আমার স্ত্রী ঘর থেকে একটা বালিশ আর কম্বল নিয়ে আসলো। আমি আলতোভাবে লম্বা দেহের বৃদ্ধকে সোফার উপর শুইয়ে বালিশটা মাথার নিচে গুজে কম্বলটা দিয়ে ঢেকে দিলাম।
আমারা বেরিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বেরল না।
নিচ থেকে গার্ড ছেলেটা আসলো। আমার স্ত্রী ওকে ঈশারাই আস্তে কথা বলতে বলল।
অত সকালে লোকটা নিচে এসে আমার নাম বলাই গার্ড ছেলেটা ওকে উপরে উঠতে দিয়েছে। গার্ড আরো জানাল যে বৃদ্ধ তাকে বলেছে যে আমি তাকে আমার বাড়ীর ঠিকানা দিয়ে প্রয়োজনে আসতে বলেছি।
গার্ড ছেলেটা নেমে যাওয়ার পর আমি চিন্তার সাগরে ডুব দিলাম। কে এই বৃদ্ধ? এবং আমি কবে এবং কেন তাকে আমার শহরের এ বাড়ীর ঠিকানা দিয়ে আসতে বলেছি?
আমার স্ত্রীর সাথেও আলোচনা করে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
পাশেই ড্রয়িং রুমে বৃদ্ধ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এবং এর মধ্যেই তার নাক ডাকার মৃদু শব্দও কানে আসতে লাগলো।

গত রাতে লেপ কম্বল গায়ে জড়িয়েও কেন জানি আমার আর আমার স্ত্রী কারোরই তেমন ঘুম হয়নি, বলতে গেলে অনেক রাত্রি জেগে ছেলে মেয়ে আর আমাদের যাপিত জীবনের গল্প করে রাত কাটিয়েছি। ঘুম না আসাতে রাতে দুজনই উঠে পায়চারী করে কিছু মুখে দিয়ে আবার বিছানায় এসেছি।
গত রাতে নরম বিছানায় লেপ কম্বলের নিচে আমাদের ঘুম হয়নি, ঘুমের অভাবে। আর এই বৃদ্ধ যিনি এখন আমাদের ড্রয়িং রুমে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তার চোখ ঘুম ছিল কিন্তু রাতে ঘুম হয়নি কন কনে শীতের মধ্যে, বিছানা আর লেপ কম্বলের অভাবে।
সকালের নাস্তা খেতে আমাদের দুজনের কারোরই ইচ্ছে হলনা। তাই আমারা দুজন ডাইনিং টেবিলে বসে বসে ফ্লাক্সে ভরা কয়েক কাপ গরম চা চুমুক দিয়ে শেষ করতে লাগলাম।

-তোমরা কেমন আছো মন্টু আর বৌমা?
বৃদ্ধের আদর ভরা কন্ঠের ডাকে আমরা দুজনই সে দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালাম।
-আমাকে পায়খানা ঘরটা দেখিয়ে দাও, আমি হাত মুখে পানি দিয়ে আসি, তারপর বৌমার হাতে বানানো নাস্তা খাব।
আমি তাড়াতাড়ি বৃদ্ধকে আমাদের গেস্ট বাথরুমটা দেখিয়ে দিলাম। আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে ঢুকল। তিনি বাথ রুম থেকে বেরুতে বেরুতে আমার স্ত্রী ডাইনিং টেবিলে আমাদের তিন জনের নাস্তা সাজিয়ে রাখল।
মাফলার খুলে নিজের গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলা হাসি ভরা মুখে তিনি ডাইনিং টেবলে এসে বসলেন। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি, তা ভেদ করে তার দাঁত বের করা হাসিটা এই মুহূর্তে আমার খুব চেনা মনে হতে লাগলো।
কোন বেওয়ারিশ লাস শনাক্ত করতে পচে গলে যাওয়া লাসের দাত পরীক্ষা করে তার পরিচিতি বের করা যায় সেটা জানি কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল কোন জীবিত ব্যক্তিকে দীর্ঘ দিন না দেখার ফলে অপরিচিত হয়ে গেলে তার দাত বের করা হাসি সব কিছুকে ছাপিয়ে তাকে আবার পরিচিত করে তোলে।

-আপনি কুদ্দুস চাচা না!
-হ্যে, বাবা আমি কুদ্দুস চাচা। প্রথমেই বুঝে ছিলাম তুমি আমাকে চিনতে পারনি, কিন্তু এই পুরনো শরীর সারা রাতের ভ্রমণের ঝক্কি ক্লান্তিতে ভরে আমাকে একদম কাত করে ফেলেছিল। তোমাদের নরম সোফায় কম্বল গায়ে ঘুমিয়ে নেয়ার পর এখন একদম ঝরঝরা।
আমার স্ত্রী কুদ্দুস চাচার থালায় নাস্তা তুলে দিতেই কুদ্দুস চাচা বললেন –বৌমা তোমার তেমন পরিবর্তন হয়নি কিন্তু বাবাজি যেন শুখিয়ে গেছে।
আমার স্ত্রী তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই, কুদ্দুস চাচা তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
-মন্টু বোধহয় খুব চিন্তাই থাকে, ছেলে মেয়েরা সব বাইরে বাইরে, অনেকদিন ওদেরকে দেখনি তাই বোধহয়।
মন্টু চাচা না আসলে আজ বোধকরি আমাদের নাস্তা খাওয়ার কোন ক্ষুধা হত না।
আসলে ক্ষুধাটা শরীরের হলেও মনের সাথে এর একটা জোগসাজোগ আছে। মন ভাল না থাকলে ক্ষুধা কমে যায়। প্রায় বছর দুই হল ছেলে মেয়েদের ওখানে যাওয়া হয়নি তাই আমরা প্লান করেছি এবার একটু লম্বা সময়ের জন্য যাব। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় আমরা না থাকলে এই বাড়ি দেখাশোনা, বিভিন্ন বিল পরিশোধ করা এগুলো কি ভাবে হবে সে চিন্তা আমাদের দুজনকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে গত কয়েক মাস ধরে।
শেষে যাওয়াটাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘কিছু একটা ব্যবস্থা হবে’ সে চিন্তা করে টিকিটও কেনা হয়েছে। জানা শোনা যারা আছে তাদের সবাইকে একজন বিশ্বস্ত লোকের জন্য বলে রেখেছি, যে আমাদের বাসায় থেকে সব সামলাতে পারে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার কোন সুরাহা হয়নি। আর প্রকৃতই সে কারণে আমরা দুজনই বেশ চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম।
-তুমিতো জান বাবা, তোমাদের বর্গা দেয়া ওই জমি চাষাবাদ করে তা থেকে আয়ের উপর আমি বেচে আছি। তোমরাতো তেমন খোজ খবর রাখনা, আমি প্রতি বছর তোমাকে দেয়া ওয়াদা মত বর্গার টাকা এতিম খানায় দিয়ে তোমার নামে রশিদ কাটি। তোমরাতো আর ওদিকে যাও না, সেই বছর দশেক আগে একবার গিয়েছিলে তোমার বাবা মারা গেলে। তারপর আর দেখা হয়নি।
সব মনে পড়ল আমার। সৎ মায়ের সংসার, তাই বাবার সাথে সম্পর্কটা চির দিন ছিল কিছুটা আনুষ্ঠানিক। বাবা মারা গেলে আমার ভাগের জমি কুদ্দুস চাচাকে বর্গা দিয়েছিলাম। কুদ্দুস চাচার দুই ছেলে, স্ত্রী মারা গিয়েছিল আগেই। বড় ছেলের বিয়ে দেয়ার পর তার ছেলের বউটা চাচাকে খুব কষ্ট দিত। তারপর ছোট ছেলের বিয়ে হওয়ার পর ছেলেরা বাবাকে একরকম বাড়ী থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল।
তখনই আমার সাথে দেখা কুদ্দুস চাচার। তিনি অনেক কষ্টে জীবন চালাচ্ছিলেন। তিনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন –বাবা আমার আর কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই, শুধু বাকি জীবনটা পার করে মৃত্যুর জন্য একটা হিল্লে হলেই হয়।
কুদ্দুস চাচার বাড়ী আমাদের পাশের গ্রামেই, আর আমার জমি খন্ড তার বাড়ীর সাথেই লাগোয়া। কুদ্দুস চাচা সে জমির এক কোনে বাসা বেধে থাকা আর ওই জমি চাষ করার জন্য দিয়েছিলাম।
-তুমি আমাকে ভাল ভাবে মরার একটা ব্যবস্থা করলে বাবা। জীবনে আপন পরের সংজ্ঞাটা একদম পাল্টে গেল বাবা। তোমরাই এখন আমার একান্ত আপনজন।
সে সব কথা মনে করে ভাবছি –এত বছর পর কুদ্দুস চাচা আসলেন, তার কোন বিপদ হল নাতো!
আমারা দুজনই বসে তাকিয়ে দেখছি কুদ্দুস চাচাকে।
তিনি খাওয়া শেষ করে বললেন।
–বৌমা খেজুরের গুড়ের পাটালি এনেছি তোমাদের জন্য। ভেবনা, বাজার থেকে কেনা না। তোমাদের জমিতে পাচটা খেজুর গাছ লাগিয়েছিলাম, তিনটে বড় হয়েছে, এ পাটালি সে গাছের রসের।
-আমার পোটলার ভিতর থেকে আমি বের করছি। তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যও নিয়ে যেতে পারবা। ওরা খুব পছন্দ করবে।
কুদ্দুস চাচা তার পোটলার ভিতর থেকে পাটালি ভরা কয়েকটা প্লাস্টিকের বৈয়মে বের করে এনে টেবিলে রাখলেন।
-যাও বৌমা, গুড়ের চা কর, সবাই মিলে খাব। আর তোমারা ছেলেমেয়েদের কাছে গেলে বাড়ীতে কি কি কাজ করতে হবে সে গুলো আমাকে আস্তে আস্তে বুঝাতে শুরু কর। এবারতো তোমরা লম্বা সময়ের জন্য যাবে। কোন চিন্তা নেই আমি সে ভাবেই গুছিয়ে এসেছি।
একটু থেমে কুদ্দুস চাচা কি একটা যেন ভাবলেন।
-মানুষ পিছু টানের জন্য বেচে থাকে, আমারতো তেমন কেউ নেই। তাই তোমাদের ফেরার টানে ততদিন নাগাদ বেচে থাকবো কথা দিচ্ছি।
কঠাটা বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন কুদ্দুস চাচা।
আমরা দুজনই নিস্পলক চোখে তাকিয়ে কুদ্দুস চাচার দিকে।

এ সময় আমাদের সত্যিই একজন বিশ্বস্ত মানুষের দরকার আর তার জন্য আমরা আমাদের নিজের বা জানাশোনা বলতে যাদেরকে বুঝি তাদের সকলেই বলে রেখেছি। কুদ্দুস চাচা তার কোন তালিকাতেই পড়ে না। তবুও সেই আমাদের এই অতি প্রয়োজনে আমাদের পাশে একান্ত আপন জনের মত এসে দাঁড়ালো।

আর এত কথা যেটা তাকে আমরা কেউ বলিনি তিনি সেটা জানলানই বা কি করে!
-কৈ বৌমা, যাও। আমি যখন এসেই গিয়েছি এখন আর তোমাদের কোন চিন্তা নেই।

মনে পড়ল কুদ্দুস চাচার সেই কথা - জীবনে আপন পরের সংজ্ঞাটা একদম পাল্টে গেল বাবা। তোমরাই এখন আমার একান্ত আপনজন।