জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১৮।

আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২৯

জীবনের অন্যপিঠ -১৮

 

এ্যজমার সমস্যটা অমরের ছোট কাল থেকেই। অতিরিক্ত পরিশ্রম আর ধুলোবালিতে সেটা বেড়ে যায়। এমন হলে এক নাগাড়ে বেশ কিছুদিন বিছানাবন্দী থাকতে হয় ওকে।
জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহন করার পর থেকে অমর একটুও বিশ্রাম করতে চায় না, প্রতিদিন কোন না কোন কাজ নিয়ে সকালেই বেরিয়ে যায়। খাওয়া ঘুমের ব্যপারেও খুব অযত্ন ওর। কারো নিষেধই শোনে না।
কাজের বাইরে আসলেই অতীত জীবনের স্মৃতি ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাইতো, কাজের মধ্যেই যেন পালিয়ে থাকতে চায় অমর।

এখানে আসার পর লন্ডনে বসবাসরত চেরীর সাথে প্রতিনিয়তই যোগাযোগ হয় অমরের। হবে না কেন? এটা তো ওর জীবনের বাস্তবতা। তবে সেগুলো ঘটে এখানকার সবার জানার আড়ালে।
একটা ছেলে আছে ওদের। চাচা আমান চৌধুরী নিজে পছন্দ করে ওর ছেলের নাম রেখেছে আকাশ। ভারী সুন্দর দেখতে হয়েছে ছেলেটা। রঙ্গে মা, কিন্তু দেখতে অবিকল অমরের মত হয়েছে বলে চেরী বলে।
চেরী একটা চাকরী নিয়েছে। ভাল বেতন, কোন অসুবিধা নেই ওর। আকাশ বা ওর নিজের ব্যপার নিয়ে কোন ভাবেই অমরকে ওর বর্তমান কাজকর্ম বা মনোযোগ ব্যহত হয় এমন কোন কাজ করে না চেরী।
এর মধ্যে ওর চাচাতো ভাই জনের সাথেও যোগাযোগ হয়েছে কয়েকবার। ও জানিয়েছে যে চেরী আর অমরের সম্পর্কের ব্যপারটা ওর বাবা অর্থাৎ অমরের চাচা আমান চৌধুরীকে সেই জানিয়েছিল।
ওদের ছেলে জন্ম গ্রহন করলে আমান চৌধুরী জনকে নিয়ে চেরীর ফ্ল্যাটে গিয়ে পোতাকে দেখে আশির্বাদ করে ওর নাম দিয়ে এসেছেন। আকাশ একটু বড় হলে আমান চৌধুরী ওকে এনে নিজের কাছে রাখবে বলে জানিয়েছেন।
এত কিছুর ব্যপারে অমর ওর মাকে কিছুই বলতে পারে না। এসবের কোন কুল কিনারাও করতে পারে না আর তাই এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে চায় না ও। কিন্তু হাতে কাজ না থাকলে চিন্তাগুলো হু হু করে ঢুকতে থাকে ওর মাথার ভিতর।
এ্যজমার কিছুটা বাড়াবাড়িতে এ কয় দিন বিছানাবন্দি হওয়ার পর থেকে ওই চিন্তাগুলোকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারছে না অমর।
আকাশকে দেখতে দারূন ইচ্ছা লাগছে। কি করবে ও এখন তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না অমর।
আকাশের বয়স তিন বছরে পড়েছে। চাচা আমান চৌধুরী আকাশকে নিয়ে রেখেছে ওর কাছে। প্রায় প্রতিদিনই চেরী দেখতে যায় ছেলেকে। চাচা আকাশের সাথে সব সময় বাংলায় কথা বলেন এবং ওকে এদেশের মত করে মানুষ করার চেষ্টা করছেন।
নিজে পিতার ভাবনার সাথে পুরোপুরি ভাবে একমত পোষন করলেও অবির চৌধুরী জমিদারীর ভাবনাটা কোন ভাবেই বড় ছেলে আমান চৌধুরীর মাথায় ঢুকাতে পারেননি। বড় ছেলে আমান চৌধুরী নিজেকে হারিয়ে পরবাসী হয়ে রইলো, যা আবির চৌধুরীকে সব সময় পীড়া দিত।
বড় ছেলে প্রথম থেকেই একটু উন্নাসিক ভাবাপন্ন। লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই নিজের পছন্দে বিয়ে করে আর ফেরেননি তিনি। বাবার সাথে তার যোগাযোগটা চিরকালই একটু ছাড়া ছাড়া। জমিদারী চালানো ওর একদম পছন্দ না গোড়া থেকেই।
আমির চৌধুরী থেকে বছর দুয়েকের বড় আমান চৌধুরী। পিঠাপিঠি দুভাই ছোটকাল থেকে বন্ধুর মত মানুষ হয়েছে। নিজেতো কখনো দেশে ফিরবেন না তায় জমিদারীটা ছোট ভাই ধরে রাখার কারণে খুব শান্তি বোধ করতেন তিনি। ছোট ভাই আমির চৌধুরীর গবেষণা লন্ডনের পত্রিকায় ছাপানোর ব্যপারে তারও কিছু ভূমিকা ছিল। ছোট ভায়ের এ কৃতিত্বে তিনি গর্ব বোধ করেন।
কিন্তু ছোট ভায়ের স্ত্রী নীলিমা চৌধুরীর আচরণ চিরিকাল ভীষণ অপছন্দ তার। প্রথমতঃ ওভাবে ওর অতি স্বতন্ত্র জীবন যাপন এবং সর্বপরী স্বামীর ওই বিপদের সময় ও আমিরকে কোন রকম সঙ্গ না দেয়ার জন্য কখনই ক্ষমা করতে পারে না ওকে।
অমরকে তার কাছে পাঠালে খুব খুশী হয়েছিলেন আমান চৌধুরী ছোট ভায়ের উপর। আমির চৌধুরী ছেলেকে পাঠানোর সময় বলেছিল -ভাইয়া, আমি কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়েই ছেলেকে হারাতে চায় না। মনে রেখ জমিদারীর ভার ওকেই নিতে হবে। তুমি ওকে দেখে রেখ। দেখ ভাইয়া, তোমার মত যেন ও চৌধুরী এষ্টেট থেকে আলাদা না হয়ে যায় কখনো। তবে তোমার আকাশের মত উদার মনটা ওকে দিতে ভুলো না।
আমিরতো অসময়েই চলে গেল। ভায়ের অকাল মৃত্যুতে অসম্ভব ব্যথীত আমান চৌধুরী। আর পরবর্তিতে অমরের এদেশীয় মেয়ে চেরীর সাথে সম্পর্কের জের হিসেবে ওদের একটা সন্তান জন্ম নেয়ার ঘটনায় নিজের মধ্যে ভায়ের ছেলের প্রতি দায়ীত্বহীনতার জন্য তার মনে একটা অপরাধ বোধ জন্ম নেয়।
আমান চৌধুরী নিজের মতেই সব কিছু করেছে জীবনে। ঐতিহ্য, আবেগ ইত্যদি সম্পর্কে বাবার কথাগুলোতে কখনোই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি আমান চৌধুরী।
স্কুল কলেজে চিরকাল প্রথম হওয়া আমান চৌধুরী নিজের উপর বোধহয় একটু মাত্রাতিরিক্ত আস্থা অর্জন করে ফেলেছিল। তায়তো চৌধুরী এষ্টেট আর দেশের গন্ডিটা ওর কাছে দম বন্দ করা দেয়াল মনে হয়েছে চিরকাল।
ওই গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করার ঘোর বিরোধী আমান। নিজ পরিচয়ে বড় হতে চেয়েছিল ও। নিজের পছন্দেই এক শেতাংগ মেয়েকে বিয়ে করেছিল জীবনের গন্ডিটা অনেক বড় করবে বলে।
কিন্তু জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় পৌছে নিজেকে বড় একাকী লাগে আমান চৌধুরীর। কাজের তাড়নায় আর কিছুটা সামাজিক নিয়মের ধারাবাহিকতায় স্ত্রী ছেলে সবাই যে যার জগৎ নিয়ে থাকে।
এই একাকী জীবনে দুধার ঘেঁসে শ্বাসরোধকারী অট্টালিকায় ঘেরা টেমসকে দেখলে যেন দম বন্দ হয়ে আসে। চোখ বুজলে মানস পটে ভেসে ওঠে ওই আকা বাকা সবুজের বুক চিরে বয়ে যাওয়া দামোদরের দৃশ্য।
ভবিষ্যতের বৃদ্ধাশ্রমের জীবনটার কথা মনে হতে দুচোখ জলে ভিজে ওঠে আমান চৌধুরীর।
প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় মন। আর সে সব কথা চিন্তা করেই আকাশকে নিজের কাছে এনেছেন তিনি। ছোট ভাইকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ওকে দেশের অন্য দশজন ছেলের মানষিকতা নিয়ে বড় করতে চান।
আমান চৌধুরী একবার ভেবেছিল যে নীলিমাকে সব কিছু বলবে। কিন্তু মন থেকে সাঈ পায়নি। তায় অমরকেই চিঠি লিখে আশ্বস্ত করেছিল।
-আকাশকে নিয়ে চিন্তা করো না বাবা। ও আমার কাছেই আছে। ওকে মানুষ করার দায়িত্ব আমার। চেরী খুব সচেতন মেয়ে ছেলেটাকে আমি তোমার পরিচয়েই মানুষ করবো। আমি বেচে থাকা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত থাকতে পার। মন চায়লে দেখে যেও ওকে যখন সময় হয়। বাবা, আমি বড় একা, মন চায় সব ছেড়ে ফিরে আসি।

সব কিছুই কেমন যেন এলোমেলো লাগে নীলিমা চৌধুরীর কাছে।
ছেলে অমর এখানে এসেছে আকস্মিক ভাবেই। বাবার অকাল মৃত্যুই টেনে এনেছে ওকে। আসার পর থেকেই জমিদারীর কাজ নিয়ে ডুবে আছে।
ছয় সাত বছর বয়স থেকে অমর মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে। তারপরতো পড়াশোনার জন্য লন্ডনে চলে গেল।
অমরকে প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই হারালেন তিনি। মাঝে মধ্যে দেখা হওয়া ছাড়া অমরকে আর কখনো কাছে পাননি।
মা হয়েও প্রকৃতপক্ষে ছেলেকে তেমন ভাবে চেনেন না তিনি। এখানে আসার পরও ওর সাথে একান্তে কথা বলার কোন তেমন সুযোগ হয়না, অনেকটা অমরের অতি ব্যস্ততার কারণে।
অমর কি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে চলে ওর মাকে! সকালে মাঝে মধ্যে আর রাতে খাবার টেবিলে ছাড়া দেখাই হয় না ওর সাথে। বিকেলে কখনো বাসায় থাকলে নিজেকে ঘরের মধ্যে এমনভাবে বন্দি করে রাখে যে ওর সাথে সে সময় কথা বলতে ভয়ই লাগে।
প্রকৃতই সারা দিনের ভীষণ ব্যস্ততা শেষে রাতে কারো সাথে কথা বলতে ভীষণ অনীহা অমরের।

অমরের সাথে কিছু কিছু ব্যপারে কথা বলা একান্ত দরকার। তায় একদিন একটু রাতে নীলিমা চৌধুরী গেলেন ছেলের ঘরে।
ভিতরে আলো জ্বলছে। দরজা খোলা, ভারী পর্দা টাঙানো।
অমরের গলা শোনা যাচ্ছে। কথা বলছে কারো সাথে।
দরজার পাশে দাড়ালেন নীলিমা চৌধুরী।
রামদয়ালের গলা।
-খোকাবাবু, মানুষের জীবন একটা প্রবাহমান নদীর মত, প্রতি মুহুর্তে এগিয়ে চলে মহাকালের টানে। জোয়ারের সময় সমুদ্র যখন ফুলে ওঠে তখন সেখান থেকে জল প্রবাহ এসে নদীর দুকুল ছাপিয়ে দেয়, সে জোয়ারে নদী নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলে কিছুটা ভ্রমেরও সৃষ্টি হয়, নিজের কাছে নিজে যেন অচেনা হয়ে যায়। কিন্তু দিন শেষে জোয়ার থেমে গেলে নদী স্বরূপে ফিরে সমুদ্রে বিলীন হবে বলে নিজ গন্তব্যের দিকে আবার বইতে থাকে।
অমর নীরবে শুনছিল রামদয়ালের কথা।
-এগোনই জীবনের ধর্ম, তোমারটাও তায়, কিন্তু একটু ভিন্ন। কারণ তোমার ক্ষেত্রে প্রবাহটা মাঝ পথে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। দুটো ভাগই চলছে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দিকে ভিন্ন গতীতে যে যার মত। এ দুটোর মধ্যে গতির যেমন মিল নেই, অমিল রয়েছে গন্তব্যেরও।
-রামদয়াল, তুমি ঠিকই বলেছ, এদুটো ধারার মধ্যে পুরোপুরিই অমিলে ভরা। দ্বিমুখী ধারার এদুটি জীবনের সমন্ময় কি করে সম্ভব তুমিই বল?
দুজনেই চুপচাপ কিছুক্ষণ।
-চৌধুরী এষ্টেটে আমি জমিদার অমর চৌধুরী। জমিদারী ঠিক ঠাক মত চালানো আর দিনে দিনে এর উন্নতী করাই আমার দায়ীত্ব, আমার লক্ষ্য। আমার জীবনের অন্য পিঠের খাতিরে এ পিঠটাকে তার সাথে মিশিয়ে আমি প্রবাহমান কোন কিছুকে বাধাপ্রাপ্ত করতে চায় না। জানিনা, এতবড় চৌধুরী এষ্টেট ওর মহত্ত্ব দিয়ে আমার জীবনের অন্য পিঠের জন্য একটু জায়গা করে মানানসই করতে পারবে কিনা!
একটু থামলো অমর। কি যেন একটা ভাবলো।
-আমার যে কোন উপায় নেই রামদয়াল! আমি যে দুটো চলন্ত নৌকায় দু’পা ভর করে দাড়িয়ে আছি, চলমান স্রেতের ধাক্কার সাথে তাল মিলিয়ে। কিন্তু স্রোতের তেজ বেশী হলে ছিড়ে দুভাগ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর যে কোন উপায় থাকবে না আমার।
অসহায়ত্বের কষাঘাতে আহত কণ্ঠ অমরের।
-কাজের বাইরে যদি কেউ কিছু নিয়ে পিড়াপিড়ি করে তবে সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকবে না।
হটাৎ করেই যেন কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠলো অমর।
কিছুক্ষণ একদম নীরবতা, চুপ চাপ কোন কথা শোনা যাচ্ছে না কারো।

ওদের কথাবার্তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে বাইরে কিছুক্ষন ওভাবে দাড়িয়ে থেকে নিজ কক্ষে ফিরে আসলেন নীলিমা চৌধুরী।