জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -১৩।

আপডেট: ০৬ অগাস্ট ২০২৩, ০৯:৫১

জীবনের অন্যপিঠ -১৩ 

 

স্বামীর মৃত্যুর পর নীলিমা চৌধুরী এ বাড়ীতে এসে একদম একাকী হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় রামদয়ালই কেবল আসে মাঝে মধ্যে তার কাছে। অন্য সবাইতো অচেনা।
স্বামী বাদে এ বাড়ীতে যার সাথে ওর যোগাযোগ ছিল সে হলো রামদয়াল। কিন্তু রামদয়াল যখন থেকে ডঃ রেবেকা বিশ্বাসের ওখানে আমির চৌধুরীর বিভিন্ন কাজ বা খবর নিয়ে যাতায়াত করতো, তখন থেকে নীলিমা চৌধুরী রামদয়ালকেও সহ্য করতে পারতেন না।

-চৌধুরী সাহেব যাওয়ার আগে আপনাকে খুজেছিলেন। বলেছিলেন আমাকে কয়েকবার। ভেবেছিলাম তিনি ভালো হয়ে উঠলে জানাবো আপনাকে। কিন্তু আমি কি করে জানবো যে ঐ সুস্থ সবল মানুষটা এভাবে সবাইকে ফাকি দিয়ে চলে যাবে।
চৌধুরী এষ্টেটে আসার কয়েকদিন পর রামদয়াল একান্তে কথাগুলো বললো নীলিমা চৌধুরীকে।
-রেবেকা ম্যাডাম এসেছিলেন চৌধুরী বাবার খারাপ অবস্থার কথা শুনে। তার পাশে বসে কথা বলেছিলেন অনেক্ষন। তিনিই কথা বলছিলেন বেশী, চৌধুরী বাবার হাতটা তার হাতের মধ্যে নিয়ে। নীরবে তার কথাগুলো শুনছিলেন চৌধুরী বাবা আর দুচোখের কোনা বয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো কেবল।
-কত কথা বলছিলেন রেবেকা ম্যাডাম, তাকে শান্তনা দিয়ে। তিনি বলছিলেন যে চৌধুরী সাহেবের মত এধরণের একটা মানুষ ও জীবনে কমই দেখেছে। কি এক বিরল সম্ভাবনা।
তারপর ছোখের জল মুছতে মুছতে মেয়েকে বললেন –মা, ওর পা ছুয়ে দোয়া ভিক্ষা কর, আমির চৌধুরীর কাছ থেকে যদি ছিটে ফোটা কিছু আর্শিবাদও পাস তাতেই ধন্য হবি তুই।
তারপর শাড়ির আচলে চোখ মুছতে মুছতে আমাকে ডেকে নিয়ে বাইরে আসলেন।
-রামদয়াল, চৌধুরী সাহেবের দিকে খেয়াল রাখিস, কি হয় কিছু বলা যায় না, ওর অবস্থা ভালো মনে হলোনা।
বার বার চোখ মুছে নিচ্ছিলেন রেবেকা ম্যাডাম। কথা বলতে তার গলাটা ধরে আসছিল।
-ওর মত মানুষ এভাবে অযত্নে অকালে মরবে কেন! ওর কি মরার বয়স হয়েছে! রামদয়াল তোর সাহেবের মত মানুষের কেন এমন হলো? ওর যে অনেক কিছু দেয়ার বাকি ছিল। আমি যতদূর দেখেছি তাতে বুঝেছি ওর চাহিদা খুবই সীমিত, ওর শুধু দরকার ছিল একটা আপন মানুষের, ওর দুঃখ সুখের ভাগিদার হওয়ার জন্য। তোর চৌধুরী বাবা খুব নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বড় হতভাগা আমির। পাশে দাড়াবার মত কাউকে পায়নি ও, তাই যাকেই পেত তাকেই নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে হালকা করতে চায়তো। কেউ ওকে বুঝতে চায়লো না, সবাই ভূল বুঝলো। তোর সাহেব বড় হতভাগা রামদয়াল।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিলেন রেবেকা ম্যাডাম। তার স্বামী মেহবুব বিশ্বাস ওকে শান্ততা দিতে লাগলেন।
-দারূন অভিমানী আমির। ওকে যদি আমি আপন করে পেতে পারতাম, ভায়ের মত অথবা সন্তানের মত।
কথাগুলো বলে রেবেকা ম্যাডাম আর একটুও দাড়ায়নি। মনে হলো তিনি যেন আর সহ্য করতে পারছেন না। স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক রকম দৌড়ে গাড়ীতে উঠে পালিয়ে গেলেন।

রামদয়ালের কথা শুনতে শুনতে স্তব্দ হয়ে বসে রইলেন নীলিমা চৌধুরী, বললেন না কিছুই।
-চৌধুরী মা, যা যাওয়ার তাতো গেছেই। যে গেছে তাকেতো আর পাওয়া যাবে না। এখন আমাদের এমন কিছু করা দরকার যাতে তার আত্মা শান্তি পায়।
একটু থামলো রামদয়াল।
-মরার আগে তিনি কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। কেউ দেখতে আসলে তার মুখের উপর চোখ দুটো একটু বুলিয়ে দিকে আমার দিকে তাকাতেন। বুঝতাম যেতে বলছে ওদেরকে।
-আমিই বসে থাকতাম তার কাছে। চৌধুরী সাহেব মাঝে মাঝে বলতেন -রামদয়াল অমর আসতে এত দেরী করছে কেন?
-অসহায়ের মত তার দুচোখের দু’ধার বয়ে জল গড়িয়ে পড়তো।

-অমর আসার কয়েকদিন আগে তিনি সবাইকে চলে যেতে বললেন। শুধু আমি তার পাশে বসা। তিনি আমার হাত দুটো তার হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন -রামদয়াল অমর যে ছেলে মানুষ, কিছুই বোঝে না। কে দাড়াবে ওর পাশে। তুই যেন ওকে ছেড়ে যাসনে কখনো। ও না বুঝে তোকে হয়তো অবহেলা করবে। কিন্তু আমি ওর বাবা হয়ে এই দুহাত জোড় করে সন্তানের জন্য আগাম ক্ষমা চাচ্ছি। তুই যেন কখনো ওকে ছেড়ে যাসনে রামদয়াল।
-আমি তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেদে উঠলাম।
রামদয়ালের কথাগুলো শুনতে শুনতে পাথরের মত স্তব্দ হয়ে রইলেন নীলিমা চৌধুরী।

অমর জমিদারীর সবকিছুই ধীরে ধীরে ওর আয়ত্বে নিয়ে এসেছে।
ডাঃ অরিূদ্ধ আর ডাঃ লাবনী মিলে অমর চৌধুরীর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য নিজেদেরকে পুরোপুরি নিয়োজিত করে ওরা হয়ে উঠেছে সে স্বপ্নের এক অবিচ্ছেদ্য ভাগিদার।
চারদিকে কর্মতৎপরতার যেন জোয়ার বয়ে চলেছে। এ সময়ে অনিরূদ্ধ আর লাবনীর মত দুজন সহযোগী অমরের জন্য বড় পাওয়া। বোঝা যায় ওরা কেউ টাকা পয়সার বা কোন বৈষয়িক কিছুর টানে এখানে কাজ করছে না বরং চৌধুরী এষ্টেটের প্রতি একটা ভালবাসার অধিকার নিয়ে অমরের পাশে দাড়িয়েছে ওরা।
অমরের মত ওরা দুজনও যেন কাজের মধ্যে নিজেদেরকে ডুবিয়ে অন্য সব কিছু ভুলতে চায়।

অমর, অনিরূদ্ধ আর লাবনী সকালে একসাথে বসেই নাস্তা করে। প্রথম দিকে না আসলেও গত কিছু দিন ধরে নীলিমা চৌধুরীও নাস্তার টেবিলে আসেন সকালে।
দুপুরের খাবারটা আলাদা আলাদা খেয়ে নেয় সবাই। রাতের খাবারের সময় ওরা তিন জন বলতে গেলে সবদিনই একসাথে বসে। ইদানিং নীলিমা চৌধুরীও আসেন মাঝে মাঝে। খাওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয় ওদের বেশ রাত পর্যন্ত।

নীলিমা চৌধুরী লক্ষ্য করেন কাজের বাইরে নিজের রূমে বা বসার ঘরে অথবা অন্য কোথাও অমর যখন একাকী বসে থাকে বা হাটাহাটি করে, ওকে তখন যেন আর চেনা যায় না। অন্য এক মানুষ অমর তখন। ও যেন অন্যখানে অন্য কোন জগতে বিচরণ করে।
ওকে দূর থেকে দেখলে একদম অচেনা লাগে নীলিমা চৌধুরীর চোখে।
অমর ওর ছেলে হলেও মা ছেলের সাথে যে স্বাভবিক একটা সম্পর্ক থাকে সেটা অবশ্য গড়ে ওঠেনি কখনো। কিন্তু কাজের মধ্যে থাকলে অমরকে যেমন প্রাণবন্ত লাগে কাজের বাইরে সেই অমরই একদম অচেনা হয়ে যায়।
খাবার টেবিলে বসে ওরা আলাপ আলোচনা করে, হালকা রশিকতা করে। ভারী ভালো লাগে নীলিমা চৌধুরীর। বিশেষ করে সকালে নাস্তার টেবিলে এধরণের সুযোগ হয়।
নিজের ছেলে হলেও প্রকৃত অর্থে অমরের এর আগের জীবনটা নীলিমা চৌধুরীর অজানা। অনিরূদ্ধ বা লাবনীর পূর্বের জীবন সম্পর্কে এখানে চাকুরীতে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয় যেটুকু তথ্য দিয়েছে তার বাইরে ওদের জীবনের সব কিছুও নীলিমা চৌধুরীর অজানা।
এ তিনটি তরুন প্রাণ তাদের জীবনের একটা বড় অংশ যা ওরা পিছনে ফেলে এসেছে তার সবটুকুই অজানা নীলিমা চৌধুরীর। তিন জনই সম্ভাবনাময় কিন্তু অতীতকে ওরা যেন দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখানে ওরা নতুন পরিচয় নিয়েই যেন সন্তষ্ট।
ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবেন নীলিমা চৌধুরী।
তিন জনই বলতে গেলে একই বয়সের। স্বভাব চরিত্রে তেমন মিল নেই। কিন্তু যে বিষয়টায় মিল আছে তা হলো -ওরা তিন জনই যেন কাজে ডুবে নিজেকে ভুলতে চায়।
মা হিসাবে ছেলেকে নিয়ে, ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন নীলিমা চৌধুরী।
অমর জমিদারীর সব কিছু সামলে নিয়ে সুন্দর ভাবে চালাচ্ছে। তাতে নিশ্চয় ওর বাবা বা ওর দাদা পর দাদার আত্মা শান্তি পাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাওতোও চিন্তা করতে হবে।
অমরের বয়স হয়েছে। বয়সের একটা আকাক্ষা আছে। সেটাই স্বাভাবিক। সেকথা ভেবে নীলিমা চৌধুরী একাধিক বার ছেলের সামনে প্রসঙ্গটা আনতে চেয়েছেন। কিন্তু সব সময়ই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায় অমর।
পাশাপাশি ডাঃ অনিরূদ্ধকে নিয়েও চিন্তা করেছে নীলিমা চৌধুরী। প্রসঙ্গক্রমে ওর জীবনের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন। প্রথমতঃ কৌতুহল, দ্বিতীয়তঃ ডাঃ লাবনী সম্পর্কে ওর মনোভাব জানার জন্য। কিন্তু ওর জবাবগুলো কোনক্রমেই পরিষ্কার না। কেমন যেন হেয়ালীপূর্ণ।
অনিরূদ্ধর বুদ্ধিমত্তা, ওর কাজে কর্মে একাগ্রতা বিবেচনায় এমন একটা গুরূত্বপূর্ণ বিষয়ে ওর হেয়ালীপূর্ণ জবাব নিতান্তই বেমানান লাগে নীলিমা চৌধুরীর কাছে।
লাবনী এখানে আসার প্রায় ছ’মাস পর ওর বাবা আসলেন মেয়েকে দেখতে। সত্তরের উপর বয়স হবে ওর বাবার, সুঠাম মেদহীন দেহের অধিকারী। রাজধানী শহরে নিজ বাড়ীতে থাকেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। জিম্বাবুয়েতে রাষ্ট্রদুত ছিলেন, সেখান থেকে ফিরেই অবসর নিয়েছেন।
হারারেতে অবস্থিত ব্রিটিশ ইউনিভারসিটিতে মেডিক্যাল সায়েন্সে পড়তে পড়তে সহপঠি সাইপ্রাসের বাসিন্দা আন্দ্রিয়াসের সাথে ডাঃ লাবনীর ভালবাসা হয়। বাবা মায়ের অমতেই বিয়ে হয় পড়তে পড়তেই। বাবার মত না থাকলেও তিনি তার অতি আদরের কন্যার সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
চাকরী শেষ করে বাবা চলে আসলেও লাবনী ওর স্বামীর সাথে থেকে যায় ওখানে। সেখানেই জন্ম ওদের ছেলে সাগরের।
পড়াশোনা শেষ করে আন্দ্রিয়াসকে নিয়ে লাবনী দেশে ফিরলো। আন্দ্রিয়াস স্ত্রী আর ছেলেকে ওর দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে অনেকবার। কিন্তু লাবনীর দেশ ছেড়ে যেতে অমতের দরূন ওদেরকে রেখে দেশে ফিরে গেল আন্দ্রিয়াস।
খুব ভালো ছেলে আন্দ্রিয়াস। এদেশের মতোই পারিবারের সবার সাথে বসবাস করার মনোভাব পোষন করে। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে যাওয়ার সময় চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেল।
এখনো নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ছেলেটার প্রতি ভীষণ দুর্বল ও। কিন্তু সব কিছুই ছেড়ে দিয়েছে লাবনীর সিদ্ধান্তের উপর।
বললেই সাগরকে যে কোন সময় নিয়ে যাবে ও। লাবনী যে কোন সময় ওর সিদ্ধান্তের কথা ওকে জানাতে পারে। নিজের ব্যপারে বা ছেলের ব্যপারে লাবনীর সব সিদ্ধান্তই আন্দ্রিয়াস মেনে নেবে।
আন্দ্রিয়াসও সবাইকে আফসোচ করে বলেছে –তার নিজের দেশ ছেড়ে, পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এদেশে বাস করতে পারবে না ও।