Heading
আপডেট: ০২ জানুয়ারী ২০২৩, ১৩:২৪
সেদিন বিকেলে বেশ হৃষ্টপুষ্ট একটা ঘুঘু ধান খেতে এসে জালের মাঝ বরাবর জড়িয়ে পড়ল। সেবার মন্টু মিয়ার ধানের ক্ষেত লম্বা লম্বা হৃষ্টপুষ্ট শীষে ভরে গিয়েছিল। পাখির উপদ্রব থেকে কষ্টের ফসল বাচাতে মন্টু মিয়া জমির চার দিকের আল বরাবর বাশের খুটি পুতে পুরো ক্ষেতের উপর সরু নাইলনের সুতোই তৈরি জাল বিছিয়ে দিয়েছিল।
আটকা পড়ে ঘুঘুটি ঝটপট করতে লাগলো কিন্তু তাতে করে সে বরং আরো বেশী বেশী করে নিজেকে জালে জড়িয়ে ফেলতে লাগলো।
ওর ঝটপটানিতে লাভ যেটা হল তা হচ্ছে জালটা কিছুটা ঝুলে পড়ে ঘুঘুটাকে ধানের শীষের সাথে লাগিয়ে দিল। আর তাতে করে সোনালী রঙ্গের দানা গুলো ওর নাগালে চলে আসলো।
সেটা টের পেয়ে ঝটপটানি থামিয়ে মনে হল কি যেন একটা ভেবে নিল ঘুঘুটা।
তারপর সেভাবে জালে জড়িয়ে থেকেই কুট কুট করে ধানের শীষ থেকে দানা গুলো ঠোকর দিয়ে দিয়ে খেতে লাগলো।
মন্টু মিয়ার ছেলেটা কিছুদিনের মধ্যে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য ওদেরকে ছেড়ে দূর শহরে চলে যাবে। তাই প্রতিদিন বিকেলে ছেলেটাকে নিয়ে ক্ষেতের ধারে যেয়ে বসে সময় কাটায় মন্টু মিয়া। বাপ বেটা মিলে হালকা সোনালী রং মাখা ধানের শীষের দুলুনি দেখে দেখে সময় পার করে।
পুরো ব্যাপারটা শুখ স্বপ্নে ডুবে থাকা কাচা বয়সী ছেলের চোখে পড়লে বিষয়টা বেশ মজার বলে তার মনে হয়ে সে অতি আগ্রহ নিয়ে তা দেখতে লাগলো।
পাশে উপবিষ্ট পড়ন্ত বয়সী মন্টু মিয়া, যে পার্থিবতার হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকটা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য, ঘটনাটা তার চোখও এড়াতে পারল না। তবে ব্যাপারটা তার কাছে কেন যেন নিষ্ঠুরতা মনে হল।
একবার ভাবল –যাই, গিয়ে জাল থেকে পাখীটাকে মুক্ত করে দিয়ে আসি। পাখিটা বোধহয় খুব ক্ষুধার্ত, আর ওর বাসায় শাবকেরা নিশ্চয় ক্ষুধাই কাতর, তাই এই অবেলায় তাড়াহুড়ো করে কিছু খাবার সংগ্রহ করে বাসায় ফেরার তাড়া ছিল। এখন জীবন জালে আটকে খাবার নিয়ে বাচ্চাদের কাছে ফিরতে পারবে কিনা সে চিন্তা বাদ দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে রইলো ঘুঘুটা।
মন্টু মিয়া লক্ষ্য করল যে জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া পাখীটা ভবিষ্যতে কি হবে সে ভাবনাকে প্রাধান্য না দিয়ে নাগালের ভিতর পাওয়া ধানের দানাগুলো সংগ্রহের চিন্তাই বিভোর হয়ে পড়েছে। মনে আশা আছে হয়তো কোন দৈব ঘটনা ওকে জীবন জাল থেকে মুক্ত করবে।
মন্টু মিয়ার পাচ সন্তানের ছোট বদর, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। চার বোনের পর ওর জন্ম। চারটে মেয়ে সন্তানের পর ওরা সবাই যখন কোন ছেলে সন্তানের চিন্তা ছেড়েই দিয়েছিল তখন ছেলেটার জন্ম। তাই সবাই মিলে ওর নাম দিয়েছিল বদর। ছেলে যেন ছিল যুদ্ধের ফসল।
স্বচ্ছল গৃহস্থালি পরিবার। মন্টু মিয়া স্থানীয় সরকারী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। পৈত্রিক সুত্রে বেশ জমিজমার মালিক। জমিগুলো কাজের লোক রেখে নিজে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করে চাষাবাদ করে।
মেয়ে গুলোর সবাইকে স্থানীয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে আশে পাশের গ্রামে বিয়ে দিয়েছে। সবাই ওরা সুখে শান্তিতে সংসার করছে। পড়ন্ত বেলার ফসল বদরকে মেয়েদের তুলনাই আরেকটু বেশী লেখাপড়া শিখিয়ে ওকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল মন্টু মিয়া।
নিজের চাকরীর স্বল্প রোজগার আর জমির ফসল থেকে আয় পরিবারের সম্বল। তাই চার চারটে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে মন্টু মিয়াকে বেশ কিছু জমিও বিক্রি করতে হয়েছে।
বদর বরাবরই ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করে আর এবার ডিস্টিংসান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে।
বদরকে শহরের ভাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে সেখানে খরচ চালানোর হিসেবটা কসতে যেয়ে মন্টু মিয়া ভারী দুশ্চিন্তায় পড়লো। ছেলের শিক্ষার খরচ যোগানোর হিসেবটা কিছুতেই যোগ বিয়োগ করে মিলাতে পারছিল না মন্টু মিয়া।
প্রতি বছর ভাল রেজাল্ট করাতে ছেলেকে উৎসাহ দিতে মন্টু মিয়া বরাবরই বদরকে শহরের দামি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করার ব্যাপারে ছেলের মনে অনেক আশা যুগিয়েছে। আর ছাত্র হিসেবে বদর খুবই ভাল, তাই অমন একটা সোনার টুকরো ছেলের জন্য সে স্বপ্নটা কোন ভাবেই অমুলক ছিল না।
বছর খানেকের মধ্যে মন্টু মিয়া অবসরে যাবে, সেখান থেকে এককালীন পাওয়া টাকা আর বাকি যে জমি টুকু আছে তা থেকে কিছু বিক্রি করে ছেলের ইউনিভার্সিটির পড়া লেখা শেষ করাতে পারলেই বদর মিয়ার আর কোন চিন্তাই থাকবে না। সে চিন্তা করে ছেলেকে দামী ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর খরচের হিসেবটা জোর করে মিলিয়ে ফেললো মন্টু মিয়া। অনেকটা ভবিষ্যতে টাকা আসার বিবেচনায় করা বাৎসরিক ঘাটতি বাজেট।
ছ মাসের মধ্যেই বদরের ভর্তির সব প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে আর সে ভাবেই বদরও সব প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত।
কিন্তু ছেলেকে এখন ভর্তি করানোর জন্য বেশ কিছু নগদ টাকার জোগান কি ভাবে হবে সে চিন্তায় মুষড়ে পড়ল বদর মিয়া। নিজের মনে একটা বাজেট মিলিয়ে স্ত্রী আর ছেলেকে সমস্যা হবে না বলে আগেই জানিয়েছে মন্টু মিয়া, তাই তার এই বর্তমান দুশ্চিন্তার কথাটা কাউকেই শেয়ার করতে পারলো না। কারণ সে সমস্যার সমাধান ওরা কেউ দিতে পারবে না।
চিন্তাই চিন্তাই বদর মিয়া নিজেকে একদম ঘর বন্দি করে ফেললো। তবুও আশা জিইয়ে রেখে ছেলেকে নিয়ে প্রতিদিন বিকেলে তার ধান ক্ষেতের পাশে যেয়ে বসে।
বদর কাঁচা পাকা ধানের শীষের দিকে তাকিয়ে সোনালী স্বপ্ন দেখে আর মন্টু মিয়া ক্ষেতের উপর দিয়ে দেখা যাওয়া কুল কিনারাহীন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে যায়।
-পেনসানের টাকা পাওয়ার এখনো অনেক দিন বাকি, আর জমি বিক্রি করাও মুখের কথা না, সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সময় যে তার হাতে নেই।
সেদিন ক্ষেতে আটকে পড়া পাখিটার দিকে তাকিয়ে এভাবে বসে থাকতে থাকতে আকাশ কখন মেঘে ছেয়ে ফেলেছে তা চিন্তায় ডুবে থাকা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চারদিক কাল মেঘের ছায়াই ঢেকে ফেলল। গুড় গুড়ুম করে মেঘ ডেকে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। একটু পরেই আচমকাই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হল।
ওরা সম্বিত ফিরে পেয়ে বাবা ছেলে মিলে অনেকটা দৌড়ে বাড়ী ফিরে আসলো।
মন্টু মিয়ার বড় উঠানের দুই ধারে দক্ষিণ আর উত্তরে মুখোমুখি উঁচু মাটির ভিতের উপর বাশের তর্জা দিয়ে বেড়া ঘেরা টিনের ছাউনির দূটো ঘর। ইতিমধ্যেই প্রশস্ত উঠানটা পরিষ্কার করে লেপে ধান উঠানোর জন্য প্রস্তুত করেছে মন্টু মিয়ার স্ত্রী। এক দিকের বড় ঘরের সাথে লাগোয়া রান্না ঘর, আর উঠানের অন্য ধারে দুকামরা বিশিষ্ট আরো একটা টিনের চালা ঘর।
উত্তরে মুখ করা রান্না ঘরের সাথে লাগোয়া বড় ঘরটাতে ওরা স্বামী স্ত্রী থাকে আর উঠানের অন্য পাশের ঘরের দূটো কামরা ছেলে মেয়েদের জন্য। বোনদের বিয়ে হওয়ার পর বদর একাই থাকে ওর একটা কামরায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বৃষ্টি আর ঝড় দুটোরই বেগ বেড়ে গেল। আকাশের বুক চিরে অবিরাম বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো, সেই সাথে মেঘের গুড় গুড়ুম বিকট ডাক।
বদরের মা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি রান্না ঘর বন্দ করে শোয়ার ঘরে আসলো।
-এ কি সর্বনাশ! সব মনে হচ্ছে লন্ড ভন্ড হয়ে যাবে আজ। কাঁচা পাকা ধানগুলো সব মাটিতে শুয়ে পানিতে তলিয়ে যাবে। কিছুই বোধহয় আর বাচান যাবে না বদরের বাপ!
স্ত্রীর মন্তব্যে মন্টু মিয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওদের ধান ক্ষেতের দৃশ্যটা। কাঁচা পাকা ধানের শীষের পাশাপাশি মনে পড়লো জালে আটকে থাকা ঘুঘুটার কথা।
নিজের অজান্তেই আঁতকে উঠল মন্টু মিয়া।
মনে হল ঝড়ের ঝাপটা এতক্ষণে জালে আটকে থাকা ঘুঘুটাকে জাল সমেত টেনে নিয়ে কোথাও আছড়ে ফেলেছে।
হয়তো এতক্ষনে কবুতরটা মরে গিয়ে সব যন্ত্রণা মুক্ত হয়েছে। আর ঝড়ের ঝাপটা ওর বাসাটাও ভেঙ্গে দিয়ে শাবকদেরকে চির কালের জন্য ক্ষুধামুক্ত করেছে।
জালটা মন্টু মিয়াই পেতেছিল, আর সে জালে জড়িয়ে ঘুঘু আর ওর পরিবারের সব ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। মরে যেন ওরা বেচে গিয়েছে!
কথাটা ভেবেই নিজের অজান্তেই মন্টু মিয়ার বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
ঘরটা অন্ধকার। কেউ কাউকে দেখতে পারছে না। মনে হচ্ছে যা কিছু আছে তার অস্তিত্ব কেবল ভাবনায়। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিই বাস্তবতাকে হাজির করে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
স্ত্রীর অলক্ষেই ঝড় বাদলের ভিতরই বেরিয়ে পড়ল মন্টু মিয়া।
ছোট একটা হাত করাত দিয়ে তাদের টিনের চালা ঘরটার ভর নিয়ে দাঁড়ানো বাশের খুটি গুলো এক এক করে গোড়া থেকে কেটে দিল। সে শব্দ ঝড় বৃষ্টির গর্জনে ছাপিয়ে ফেলে তার স্ত্রী আর ছেলের কান পর্যন্ত পৌছাল না।
কাজ শেষ করে মন্টু মিয়া এক দৌড়ে ছেলেকে উঠানের ওপারের ঘর থেকে ডেকে ওদের শোয়ার ঘরে নিয়ে আসলো। পরিবারের সবাইকে মন্টু মিয়া এক ছাউনির তলে জড় করল।
-এ ঝড় বৃষ্টি থামার না, আমরা সবাই আজ রাতে এ ঘরেই ঘুমবো।
এভাবে তার স্ত্রী আর ছেলেকে এক ঘরে আনার কারণ জানার জন্য মা আর ছেলে পরিবারের একমাত্র ভরসা মন্টু মিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় কথাটা বলল মন্টু মিয়া।
রাতের আঁধারে ঝড় বৃষ্টি তার সর্বাত্মক ধ্বংসাযজ্ঞ চালিয়ে সকাল হয়ার কিছু আগে যেন কাজ শেষ করে ধীরে ধীরে শান্ত হল।
ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের মানুষ এক এক করে বাইরে আসতে লাগলো।
মন্টু মিয়ার ক্ষেত সহ আশেপাশের সব কাঁচা পাকা ধান ঝড়ের তোড়ে শুয়ে পড়ে বৃষ্টিতে জমা পানিতে ডুবে গেল। মন্টু মিয়ার জমিতে টাঙ্গানো জাল আর তাতে জড়িয়ে পড়া ঘুঘুটির কোন নিশানা কোথাও দেখা গেল না।
মন্টু মিয়ার উত্তর আর দক্ষিণ মুখী দুটো ঘরের মাথার উপরের টিনের ছাউনি সরাসরি ভেঙ্গে থুবড়ে পড়ে মেঝের সাথে মিশে রইল।
উত্তর মুখী ঘরটার বাশের খুটিগুলো মন্টু মিয়া নিজ হাতে গোড়া থেকে কেটে দিয়েছিল সেটা অন্য কেউ না জানলেও মন্টু মিয়া জানতো। কিন্তু দক্ষিণ মুখী ঘরটাও একই ভাবে থুবড়ে পড়লো! ওটার খুটিগুলোও কি কেউ কেটে দিয়েছিল! কেউ সেটা কাটলেও তার কথা মন্টু মিয়া সহ ওরা কেউ জানে না।
ঝড়টা কি ঈশান বা বায়ু না অন্য কোন কোণ থেকে এসেছিল তার খোজও কেউ জানে না।
মন্টু মিয়া উত্তর মুখী ঘরটার বাশের খুটিগুলো না কাটলেও কি দক্ষিণ মুখী ঘরটার মত ওটাও নিজ থেকে মুখ থুবড়ে পড়তো! সে কথাও কেউ জানে না।
এসব প্রশ্ন অজানা থেকেই সব জীবন থেমে যায়। এটাই নিয়তি!
জীবনে আমরা সবাই মন্টু মিয়া, কেবল স্থান কাল পাত্রের ভিন্নতা।
সব জীবনের ভবলীলা শেষ হয় নিশ্চিত কিন্তু কোন জীবনই পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ হয় না।
কোন জীবন শেষ হয় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কাছে নতি স্বীকার করে যাকে আমরা ভাগ্য বা পরিণতি বলে নিজেদেরকে বুঝ দিই।
আবার কোন জীবন শেষ হয় প্রকৃতির কাছে হার মেনে। অনেকটা লাইফ সাপোর্টে রাখা কোন অন্তিম শয্যাই শায়িত রোগীর কৃত্রিম সংযোগ গুলো সরিয়ে ফেলার মত।
শুরুর মত জীবন শেষ করার কাজটাও প্রকৃতিই করে।