জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প 'ধরানগরের ধরাপতি ও নরাধম'। ।

আপডেট: ০৪ অগাস্ট ২০২৪, ১১:৪৯

ধরানগরের নরপতি ও নরাধম

-শোন নরাধম, এখানে দাড়িয়ে ডানে বায়ে সামনে পিছনে তোর দৃষ্টিসীমার মধ্যে যা কিছু পড়ে, তার সবটুকু তোকে দিয়ে দিলাম।
নরপতি একদিন প্রত্যুষে নরাধমকে ডেকে বললেন।
ছানাবড়া চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নরাধম তাকালো নরপতির দিকে। যদিও সে জানে যে এ ধরানগরে যা কিছু চোখে পড়ে তার সবকিছুর মালিক নরপতি মহাজন। তাই সব কিছু দেয়ার ক্ষমতা তার আছে।
-হ্যে, সব কিছুই তোর।
ওর হতভম্ব ভাব দেখে নরপতি তাকে আশ্বস্থ করলেন।
-তুই আর তোর বংশধরেরা আজীবন ভোগ করবি এর সব ফসল।
তেমনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে নরাধম।
-এখন যা, তোর মত করে সীমানা খুটি গেড়ে নে। শক্ত করে গাড়বি। কোন চিন্তা নেই যদি নিজ নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থাকিস। মনে রাখবি, সীমা ডিঙানো আমি একদম পছন্দ করিনা।
-নরপতিরতো কোন কিছুরই অভাব নেই। যত খুশী আর যাকে খুশী দিতে পারেন তিনি।
ভাবলো নরাধম। অবাক হলেও অবশেষে বিশ্বাস হলো নরাধমের।
-তবে, যৎসামান্য খাজনা দিতে হবে তোকে।
খাজনা দেয়ার কথায় আবার অবাক হলো নরাধম।
-যার কোন অভাব নেই, তিনি এই নরাধমের কাছ থেকে খাজনা নিয়ে করবে কি!
ভাবলো সে।
-বেশী নয় হাজারে এক ভাগ।
নরপতি থামলেন একটু। বোধহয় ওর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আঁচ করার জন্য।
-তোর দেয়া খাজনা তোর জন্যই জমা থাকবে, যেভাবে দিবি ঠিক সেভাবেই আবার তোর প্রয়োজনেই আমি তোকে তা ফিরিয়ে দেব সেখান থেকেই।
নরপতির এই সরল সহজ কথা বুঝে উঠতে বেশ কষ্ট হতে লাগলো নরাধমের।
-ঠিক আছে, তোর খাজনা দেয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য, তোর জমির কোণে স্বচ্ছ একটা হাড়ি বসিয়ে রাখবো। যাতে করে তোর দেয়া জমা খাজনার পরিমাণ তুই নিজেই দেখতে পাস। তাতে করে, প্রতিদিন তুই ওটা দেখবি আর বুঝবি কত দিলি আর কত জমা হলো।
আশ্বস্থ হয়ে একটা নিঃশ্বাস টানলো নরাধম।

-হাড়িটার মধ্যে তুই তোর খাজনা ঢুকাতে পারবি যে কোন সময়। তবে তার থেকে কিছু বের করতে হলে চায়তে হবে আমার কাছে। চাওয়ার সময় কেবল জমার পরিমাণটা দেখে নিবি। তবে কথা দিচ্ছি- তোর জমা কিছু থাকলে অবশ্বই আমি তোকে তা ফিরিয়ে দেব।
কৃতজ্ঞতায় কাচুমুচু হয়ে সামনের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে নরপতিকে কুর্ণিস করলো নরাধম।
-তোর জমার হিসেব করার আরো একটা সহজ উপায় বলে দিই। তোর উদপাদিত ফসলের খাজনা হিসেবে যে অংশ জমা করবি তা যদি নিখুত হয় তবে আরো পুরষ্কার আছে।
আবার অবাক হলো নরাধম।
-প্রতিটি নির্ভেজাল খাজনা স্বরূপ প্রদত্ত ফসলকে আমি এক হাজার গুণ বৃদ্ধি করে তোর জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দেব।
আনন্দের অতিশয্যে নরাধম এবার কাঁদতে শুরু করলো।
-তবে তোকে বলে রাখি, ভেজাল কোন খাজনার স্থান কিন্তু খাজনার হাড়িতে নেই।
কান্না থামিয়ে আবার চোখ ছানাবড়া করে তাকালো নরাধম।
-ভেজাল খাজনার অংশ যত সামান্যই হোক না কেন, ওই ভেজাল ফসল হাড়ির ভিতরকার জমানো সব নির্ভেজাল ফসলকে নিঃশ্বেষ করে দেবে।
-মনে রাখবি, খাজনায় একটু ভেজালও যেন না থাকে। আমার হাড়িতে ভেজালের কোন স্থান নেই।
নরধম এবার সত্যিসত্যিই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইলো।
-তবে, চিন্তার কোন কারণ নেই। কোন কারণে তোর জমিতে ফসল যদি কম ফলে বা নাই ফলে তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ফসল কম খাজনা কম। ফসল নেই খাজনাও নেই।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো নরাধমের বুক খালি করে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশাস নিল।
-তবে হাড়িটা প্রতিদিন দেখে পরীক্ষা করে, ওটার উপর ময়লা পড়লে তা মুছে পরিষ্কার করে রাখতে ভুল করিসনে। তাহলে ওটার স্বচ্ছতা অটুট থাকবে। আর ইচ্ছে মত তোর জমার পরিমাণটাও দেখে নিতে পারবি। আন্দাজের উপর ভর করতে হবে না।
আবার মাটিতে মাথা নুইয়ে নরপতিকে প্রনাম জানিয়ে তাঁর দয়ায় প্রাপ্ত সুবিস্তৃত ক্ষেত খামার বুঝে নেয়ার কাজে মনোনিবেশ করলো নরাধম।
অসীমতার মাঝে ইচ্ছেমত ডানে বায়ে সামনে পিছনে যতদূর দৃষ্টি যায় সেভাবে সীমানা ঠিক করে নিল নরাধম। নিজের সাধ্যমত পরিশ্রম করে প্রতিটি ঘামের ফোটায় ফোটায় ওর ক্ষেতকে সবুজ শস্যের আভায় উদ্ভাসিত করলো।
মৃদু মন্দ বাতাসে শস্যের সরু সরু ডগা গুলোর দুলুনি ওকে মোহিত করলো।
শস্য ঘরে তুলে গুণে গুণে খাজনার হাড়িতে খাজনা দিল। স্বচ্ছ হাড়িতে ওর জমানো খাজনাগুলো দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল নরাধমের।

প্রতি দিন দেয়া খাজনার পরিমাণের সঠিক হিসেব রাখার জন্য নরাধম পাশের পাহাড়ের কঠিন পাথরে খোদায় করে করে হিসেব লিখে রাখতে লাগলো।
সবুজ শস্যের চাদোয়ার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে, বুক ভরে তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিল নরাধম।
-কি অপার মহিমা নরপতির!
তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসলো নরাধমের।
শস্যের মিষ্টি সুবাস দিনে দিনে নানা রংবেরঙের মধুকরদের আকৃষ্ট করলো। ওরাও সৌন্দর্য্যরে নৈসর্গিকতায় গুনগুনিয়ে নানা সুরে গান করতে লাগলো।
শত শহস্র মধুকরদের মধুকণ্ঠের গুনগুনোনি নরাধমকে আকৃষ্ট করলো।
নানা প্রজাতির মধুকর আর ওদের রঙের বর্ণচ্ছটা আর পাগল করা গন্ধ, ধ্যাণ ভঙ্গ করলো নরাধমের।
কি অপরুপ! ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো ওদেরকে।
রংবেরঙের সব মধুকরদের ছুয়ে দেখার মধ্যে কি এক অভুতপূর্ব শিহরণ! ওদের ছোয়া মাতোয়ারা করলো নরাধমকে।
যত মধুকরদের আগমন ততোই বিচিত্র বর্ণের চ্ছটা, ততোই সুগন্ধ।
ওদেরকে আরো বেশী করে আকর্ষন করার জন্য, ক্ষেতগুলোকে আরো অধিকতর ফসলে ভরপুর করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো নরাধম।

প্রথমে ক্ষেতের যে সীমানা খুটি গেড়েছিল তা বাড়ানোর একটা তাড়না অনুভব করলো নরাধম।
পাশে দিগন্ত জোড়া ক্ষেত। একদম ফাঁকা পড়ে আছে, জংলা। নিজের সীমানা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে সেখানে চাষ করলে আরো বেশী সংখ্যায় মধুকরদের আকর্ষন করা যাবে।
একটু ভাবলো নরাধম।
-জংলা জমিগুলো পরিষ্কার হবে আর তাতে ফসলের পরিমাণও বাড়বে। তার জন্য বাড়তি খাজনাও প্রদান করবে।
ভাবলো নরাধম।
নরাধমের ফসলের ভান্ডারে এখন অনেক ফসল। তায় আজকাল খাজনা দেয়ার সময় অত গুণে দেখে না নরাধম। বেশী বেশী করে দিয়ে দেয়।
তাই, খাজনার ব্যপারে কোন চিন্তা নেই ওর। নরপতির খাজনা একটুও কম দেয়নি সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত নরাধম।

তাই, নিজের সীমানা ইচ্ছামত বাড়িয়ে নিল নরাধম।
তার পর থেকে, অনেক বেশী সংখ্যাই রংবেরঙের মধুকরেরা সারা বছর ভীড় জমাতে লাগলো ওর দিগন্ত জোড়া ক্ষেতে।
দলে দলে ঝাকে ঝাকে আসা মধুকরদের নানা বর্ণ, গন্ধ আর নানান সুরে ওদের গুনগুনোনি তৃপ্তিতে ভরপুর করলো ওর সারা দেহ মনকে।
-নরপতিও নিশ্চয় খুশি বেশী বেশী খাজনা পেয়ে।
কথাটা ভেবে অভূতপুর্ব এক তৃপ্তিতে চোখ বন্দ করলো নরাধম।

সেবার বর্ষার মৌসুম আসার আগেই অন্যান্য বারের মত আকাশ কালো করে মেঘ করলো। তারপর মেঘ আরো ঘন হয়ে বৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হতে লাগলো।
উঁকি ঝুঁকি মারা সবুজ শস্যের কচি কচি ডগার উপর আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোটা পড়ার কথা ভেবে নরাধম সুখ স্বপ্নে ডুবে রইলো।
বৃষ্টির ফোটা পড়বো পড়বো করেও যেন পড়ছে না।
সময় গড়াতে লাগলো। দিন, মাস কেটে যেতে লাগলো কিন্তু বৃষ্টির ফোটা আর পড়লো না।
জেগে উঠলো নরাধম।
পানির অভাবে নরাধমের চোখের সামনেই শস্যের সবুজ কচি কচি ডগাগুলো ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে শুখিয়ে গেল।
মধুকরের দলও ধীরে ধীরে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।
সামনে কেবল শুখনো ধুধু মাঠ।

নরপতিকে মনে পড়লো নরাধমের।
এতকাল জমানো খাজনা থেকে কিছু অংশ চেয়ে নেবে বলে মনস্থ করলো নরাধম।
কিন্তু ঠিক কত জমা আছে তার হিসেবতো ওর কাছে নেই। প্রথম প্রথম হিসেবটা রাখলেও পরে নানা ব্যস্ততার জন্য পরে আর সেটা আর রাখা হয়নি।
তবে নরপতির বেধে দেয়া পরিমাণের থেকে অনেক বেশী জমা দিয়েছে সে ব্যপারে নিশ্চিত নরাধম। তায়তো মনে জোর আছে ওর।
নরপতির কথামত -হাড়ির জমা খাজনা দেখে হিসেব করে তবে চেতে হবে। ছুটে গেল হাড়িটার কাছে।
কিন্তু বহুদিন ধরে মোছামুছি না করার ফলে স্বচ্ছ হাড়িটা দিনে দিনে যে ভাবে কালো হয়ে গেছে তাতে ভিতরে কি আছে তা একদমই দেখার উপায় নেই।
কি করবে এখন ও!
হাতের গামছা দিয়ে অনেক করে হাড়িটা মুছে পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই ময়লাগুলো গেল না।
মরিয়া হয়ে উঠলো নরাধম। হাতের পাশে যা আছে তায় দিয়ে ঘসা মাজা করতে লাগলো হাড়িটা।
ক্লান্ত হয়ে গেল নরাধম কিন্তু হাড়ির উপর দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কালো ময়লা কিছুতেই পরিষ্কার হলো না। আফসোসে সারা দেহ মন ভরে উঠলো নরাধমের।
তারই কষ্টে তৈরী সবুজের সমারোহে মোহিত হয়ে নানা বর্ণের মধুকরেরা আসলো দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে। ওদের বর্ণচ্ছটা আর সুমধুর গুঞ্জন একদম আত্মহারা করে রেখেছিলো নরাধমকে।

দিগন্ত থেকে আসা মধুকরেরা নরাধমের ভরা শস্যের ক্ষেতকে মুখোরিত করে রেখেছিলো। ওরা নরাধমকে কত আনন্দ, কত তৃপ্তি দিল।
তায়তো নরাধম বলতে গেলে ওদের প্রেমে মজে ছিল।
ওরা না চায়তেই নরাধম নিজের থেকেই নিজের তৃপ্তিতেই আরো বেশী বেশী মধুকরদের আকৃষ্ট করতে ওর ক্ষেতের সীমানা নিজের মত করে বাড়ালো বারবার।
আর প্রতি মৌসুমে নতুন নতুন মধুকরের আগমন ওকে যেন পাওয়ার নেষা আর ভোগের নেষায় উম্মাদ করে দিল।
কিন্তু তায় বলে নরপতিকে সময়মত খাজনা দিতে একদম ভুল হয়নি ওর। ব্যস্ততার জন্য আর বিশেষ করে সীমানা বাড়ানোর ফলে ফসলের পরিমাণ এত বেশী হলো যে গুণে হিসেব করা অসম্ভব হয়ে পড়লো ওর পক্ষে। আর তায়তো আন্দাজের উপর নির্ভর করে যাতে কোন ভাবেই কম না পড়ে সে জন্য অনেক বেশী বেশী ফসল খাজনা হাড়িতে ভরেছে নরাধম।
কিন্তু এখন কি করবে ও! কি ভাবে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে। আফসোসে বুকটা ভারী হয়ে উঠলো।
ক্লান্ত হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চিৎ হয়ে মাটিতে শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো নরাধম।
গুড়ু গুড়ু মেঘ ডাকলো আকাশে। দু’এক ফোটা করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো।
বহু প্রতিক্ষিত বৃষ্টির ফোটা ওর চোখ মুখ আর সারা দেহে পড়ে ওর শরীর মন জুড়িয়ে দিল।
ধরে আসলো বৃষ্টি।
একটুও নড়তে ইচ্ছে হলো না নরাধমের। ভিজলো অনেকক্ষন ধরে।
তারপর চোখ দুটো মেললো নরাধম।
চমকে উঠে বসলো।
বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে হাড়িটা ঝকঝক তকতক করছে। স্বচ্ছ হাড়িটার ভিতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
চমকে উঠলো নরাধম।
একি খালি কেন ওটা! ওর জমা দেয়া অত অত খাজনা কোথায় গেল?
তাকালো আকাশের দিকে। অঝরে বৃষ্টি পড়ছে কেবল। বৃষ্টির পানিতে গাছ পালা পাহাড় মাটি সব ধুয়ে মুছে মৃদু মন্দ বাতাসে ডাল পালা আন্দোলিত হচ্ছে।

আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকালো।
উঠে দাড়ালো নরাধম।
-সীমানার খুটি সঠিক ভাবে গাড়তে হবে।
দিগন্তের দিকে হন হন করে হেটে চললো নরাধম।