জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২৪।

আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:২০

অম্বরাবনী-২৪ 

 

সব ফেলে সব ছেড়ে অবনী এখন নিজ উৎপত্তিতে, একদম মাটির কাছাকাছি। আহ এত কাছে এত আপন করে মাটিকে কাছে পায়নি কত দিন।
খোলা বারান্দায় পাতা ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল অবনী।
কতদিন বৃষ্টি হয় না কে জানে। চারিদিক সব শুকনো যেন হাহাকার করছে। লনের ঘাসগুলো পানি অভাবে সব মরে গেছে, বিবর্ণ গাছগুলো তৃষ্ণার্ত নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্বাক দাড়িয়ে আছে।
বিদ্যুৎ চমকালো, থেকে থেকে ঠান্ডা হাওয়ার দমকা ওর চোখ মুখ আর সারা শরীরে পরশ বুলিয়ে যেতে লাগলো। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরূ হলো। উত্তপ্ত মাটির বুকে বৃষ্টির ফোটা তৃষ্ণা যেন আরো বাড়িয়ে দিলো।
বৃষ্টির ফোটার পরশে উত্তপ্ত মাটির একটা কাচা গন্ধ ওর নাকে এসে লাগলো। মনে হলো- এত শুধু গন্ধ নয় যুগ যুগ ধরে জমে থাকা বেদনা মিশ্রিত অনুযোগ।
- তাহলে আমি যায় খোড়া বাবু?
আল্লারাখা চলে গেল। তার দিকে তাকিয়ে দেখলো অবনী।
-আল্লারাখা কি ইচ্ছে করেই ওকে খোড়াবাবু বলে ডাকে!
এত বছর আজ হটাৎ করেই প্রশ্নটা আচ্ছন্ন করল অবনীর মনকে।
গাছগুলোতে বাতাসের ঝাপটা লাগছে। মনে হচ্ছে ওরা হাত প্রসারিত করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বিধাতার সাথে কথা বলতে লাগলো।

শেষ পর্যন্ত ঢল নামলো আকাশ থেকে, প্রতিক্ষিত আষাড়ের ঢল। ঢলের পানি সমস্ত ধুলো বালি জঞ্জাল ধুয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
বৃষ্টির ছিটে ফোটা অবনীর মুখের উপর ছিটকে পড়ছে। শরীর ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে। কত দিন ভেজেনি ও এভাবে, ভাবল বৃষ্টির পানিতে ভিজলে কিছু হবে না তাতে। স্বয়ং বিধাতার ছোঁয়া ছাড়া অন্য কিছুই পৃথিবীর তৃষ্ণা মেটাতে পারে না।
এমুহুর্তে অবনী যেন প্রকৃতির অংশ হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষন আগে বিদঘুটে গরমে বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা গায়ের ঘাম সুখিয়ে আসতে লাগলো। আহ কি প্রশান্তি! কি মধুর প্রকৃতির ছোয়া!
সহসা গাছ পাতা আর ভেজা মাটির গন্ধকে ছাপিয়ে এক মাদকীয় গন্ধ অবনীর নাকে এসে লাগলো। আলো আধারীতে আধবোজা চোখ মেলে দেখলো পাশে অম্বর!
আহ সে জন্যইতো ঐ মাদকীয় গন্ধ। এত মর্তের নয় স্বর্গের গন্ধ!
অম্বর ওর একদম গা ঘেসে বসেছে। দৃষ্টিটা গাছের ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া আকাশের দিকে।
কতদিন অম্বরের সাথে একান্তে কথা হয়নি অবনীর। অম্বরের অবস্থান অবনীর মন শরীর প্রাণ জুড়ে। অবনীর যত কর্ম প্রচেষ্টা সব কিছুই অম্বরকে খুশী করার জন্য। অম্বরতো ওরই অংশ তায় ওকে খুশী করার জন্য অবনী যা কিছু করেছে তাতে কোনদিন ওর মতামত নেয়ার কোন আকাঙ্ক্ষা বোধ করেনি। নিজের সুখই অম্বরের সুখ মনে করেছে।

অবনীর মনে হলো এইতো সময় কিছুটা হিসেব মেলানোর। জীবনের অন্য সব হিসেবে যখন গড়মিল দেখা দিয়েছে তখন অবনীর সাথে অম্বরের হিসেবটা মিলিয়ে দেখার একটা তাড়না অনুভব করলো।
অম্বর খুশী থাকলেই ওর প্রচেষ্টা সফল। ভাবল অবনী।

অম্বরের দৃষ্টি দূরে আকাশের দিকে নিবদ্ধ। চারপাশের পৃথিবী, এই বৃষ্টি, বয়ে যাওয়া পানির কুল কুল শব্দ, মাটির গন্ধ এসব যা কিছু পার্থিব তার কোন কিছুই যেন ওকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। ওর টান যেন অন্যখানে অন্যকিছুর দিকে।
এই মুহুর্তে অবনী যখন সবার কাছ থেকেই জবাবটা পেয়ে গেছে তখন শুধু অম্বরের কাছ থেকে জবাবটা পেলেই ও তৃপ্ত হবে।
কাজের ব্যস্ততায় আর অংকের হিসাব মিলাতে যেয়ে অম্বরকে এভাবে এত গভীর ভাবে এর আগে অবনী কখনো অনুভব করার সুযোগ পায়নি। উপরে উঠার প্রচ্ছন্ন একটা আকাঙ্খা ওকে সারাক্ষন নেশাগ্রস্থ করে রেখেছিল এতকাল।
এই মুহুর্তে অবনী নিজেকে বাইরের পৃথিবী থেকে একদম আলাদা করে অম্বরের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করলো।
কিন্তু একি! অম্বরের মাদকীয় গন্ধে অবনীর শরীর মন ক্লান্তিতে ভরে যাচ্ছে কেন! আপ্রান চেষ্টা করেও চোখের পাতা দুটো খোলা রাখতে পারছে না।
শরীরের সব শক্তি দিয়ে যতটুকু পারা যায় চোখ দুটো খোলা রাখার চেষ্টা করলো অবনী।

মুসলধারে বৃষ্টিতে চারিদিকে জল থৈ থৈ করছে। নদী মাঠ গ্রাম সব মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তারই ছোয়াই শান্ত ধরনী আর পরিতৃপ্ত গাছগুলো বিমূর্ত হয়ে আছে।

হটাৎ করে সামনে সরূ একটা নদী চোখে পড়ল। ঘাটে একটা নৌকা বাধা। এপারটা একদম ফাঁকা। আর কুয়াসার জন্য ওপারটা মোটামুটি ঝাপসা। তবে ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখলে আবছা বোঝা যায়। মনে হয় ওপারে আছে অনেক কিছু।
মৃদু মন্দ স্রোতের টানে নৌকাটা দুলছে আর বাধনটা ছিড়ে চলতে শুরূ করার প্রয়াস পাচ্ছে।
আকাশ থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ এসে খসে পড়লো নৌকটার উপর। অমনি বাধন খুলে চলতে শুরূ করলো নৌকাটা।
নৌকাতে অবনী আর অম্বর।
অম্বরকে মনে হচ্ছে অপ্সরি। মাদকীয় গন্ধে ভরা ওর শরীর। ওর মাদকীয় গন্ধে ডুবে আছে অবনী- নেশাগ্রস্থ আপনভোলা।
স্রোতের টানে আপন গতীতে আপন দিকে চলেছে নৌকা। স্রোতের গতি মত্থর কিন্তু অবিরাম, এক মুহুর্তও যেন এদিক ওদিক নেই।
নদীর দুপাড় কখনো সবুজ কখনো ধুসর আবার কখনো মরূ, কখনো সমতল কখনো পাহাড়ী, রূপ রস গন্ধে ভরা। সব কিছুই মনভোলানো। হাত বাড়ালেই সব পাওয়া যায়। কি আনন্দ কি মধুময়।
অবনী ওর সকল ঈন্দ্রিয় দিয়ে দুপাড়ের রূপ রস গন্ধ থেকে যা নেয়া যায় অকাতরে তা উপভোগ করছে। ইচ্ছামত সুবিধা মত ঘাটে ঘাটে নেমে ওর সাধ্যের সব কিছু অম্বরের জন্য নৌকায় তুলে নিচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজেকে উজাড় করে অম্বরকে দেয়ার মধ্যেই ওর সব তৃপ্তি অনুভব করছে।
অবুঝের মত এত কিছু তেমন যাচায় বাছাই না করে নিতে নিতে কখন দিন রাত বছর কেটে যাচ্ছে সেদিকে খেয়ালই নেই অবনীর। পাওয়াতেই ওর আনন্দ। হাতের ছোয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার সব কিছুই ওর পাওয়া চায়।
একটুও সময়ের অপচয় করতে চায়না অবনী। পাওয়ার অনন্দ ওকে নেষাগ্রস্থ করে ফেলেছে। কোন ক্লান্তিই ওকে যেন স্পর্শ করতে পারছে না। একটুখানি থামার সময়ও যেন ওর নেই।
ওদের বহনকারী নৌকাটা একটু পরীক্ষা বা মেরামত করবে সে সময়ও যেন ওর নেই। চলাতেই ওর আনন্দ। জীবন মানেই যেন শুধু সামনে চলা।
নদীতে ঝড়, ঝঞ্জাতো আছেই। এর সবকিছুকেই অগ্রাহ্য করে নতুন নতুন পাল তুলে, অভিনব উপায় উদ্ভাবন করে এগিয়ে যাওয়াই ওর ব্রত।

কতদুর যাবে, কোথায় থামবে তার কোন কিছুই ওর জানা নেই, আর সেদিকে খেয়াল করার কোন ফুসরত নেই।
মাঝে মধ্যে, ওর বাহনটার কিছু সমস্যা বা বাইরের প্রাকৃতিক সমস্যা ওর নিরবিচ্ছন্ন পাওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্যহত করলে অবনী যার পর নেই বিরক্ত হচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ওর বর্হিমুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করে নিজের দিকে দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে বাধ্য করছে।
দেহ মনে বিরক্তিভরে নিরূপায় হয়ে কোন এক অজানা শক্তির কাছে পরাভুত হতেই হচ্ছে মাঝে মধ্যে। ভাবছে এগুলোই ওর জন্মসুত্রে প্রাপ্ত দুর্বলতা।
নিজের বাহনের বা বাইরের প্রকৃতির কিছু কিছু সমস্যা সংকুল সময়গুলোতে অবনী নিরূপায় হয়ে কিছু একটা করার জন্য বিরক্তিভরে নিজেকে নিয়ে ভেবেছে। আর কেবলমাত্র এই সময়টুকুতেই অম্বরকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে আর এই বিপদ সংকুল পথে ওদের বাহনটার স্থায়ীত্ব নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু তা ক্ষনেকের জন্য। নতুন দিনের সুর্য্যরে হাতছানি আবার পাওয়ার নেশায় ওকে বিভোর করে দিয়েছে।
চলার পথে ওর আশে পাশে এমন আরো অনেক নৌকা ভাষছে দেখা যাচ্ছে। তার কোনটা বা পুরোনো হয়ে আবার কোনটা বা একদম শুরুতেই আকস্মিকভাবেই তলিয়ে যাচ্ছে। ওর কর্মব্যস্ততার মধ্যে আশেপাশের নৌকাডুবির ঘটনা ক্ষনেকের জন্য হলেও ওর চলার গতিকে ব্যহত করেছে। একটু অন্যমনষ্ক করেও দিয়েছে ওকে। কিন্তু পরক্ষনেই দুই তীরের রং রূপ রস গন্ধ ওকে মাতোয়ারা করে ঐসব অজানা ভবিষ্যতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরনা যুগিয়ে চলেছে।
অনেক দিন, অনেক মাস বছর পেরিয়ে ওদের নৌকাটা ধীরে ধীরে সরূ নদী পাড়ি দিয়ে প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর নদীতে পড়ছে।
এখান থেকে মনে হয় যেন নদীর অনেকগুলো পাড়। কিন্তু কোন পাড়ই ভাল করে দেখা যায় না। এ যেন সহস্র পাড়ের মহাসন্ধিক্ষন। এ যেন অতল মহাসমুদ্রের এক মহা সন্মেলন স্থল। এই জায়গাটাতে এসে সবাই যেন একটু দিকভ্রষ্ট, দ্বিধান্বিত।
অবনী ভাবে- না, সরু নদীটাই ভাল ছিল, দুপাড়ই দেখা যেত। সব কিছুই হাতের মুঠোর মধ্যে মনে হতো। ইচ্ছেমতো নদীতে লাফ দিয়ে সাতরিয়ে, ডাঙায় দৌড়াদৌড়ি করে সব কিছু উপভোগ করা যেত।

কিন্তু জীবিকার জন্য একটা পাড়েতো নামতেই হবে। কারণ যা কিছু দেখার মত, নেয়ার মত তার অবস্থানতো পাড়ে। নেয়ার জন্য যারা ছুটছে জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য যারা তৎপর একটা না একটা পাড়ে তো তাদের যেতেই হয়।
অবনীর দৃষ্টি সীমার মধ্যে ওর সামনে পিছনে আশে পাশে আরো অনেক নৌকা ভাষছে। কিন্তু এখানকার স্থায়ীত্ব কারোরী বেশীক্ষনের নয়। জীবন জীবিকার তাগিদে একটা না একটা পাড় বেছে নিচ্ছে সবাই।
হটাৎ হটাৎ করেই স্রোতের টানে সবাই কোন না কোন কুলের সন্ধানে পাড়ী জমাচ্ছে। যেন হরিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ ভূবনে।
স্রোতের অমোঘ নিয়মে অবনীও একদিন কুলের সন্ধানে ছিটকে চলে এসেছে একুলে।
অনেক কিছুই এখানে আছে নেয়ার মত, ভোগ করার মত। তার অনেক কিছুই দুহাত ভরে নিয়েছে অবনী। আবার অনেক কিছুই নিতে পারেনি। মরিচিকার মত দেখা দিয়ে ছোয়া দিয়ে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। হাসিতে বিষাধে ভরা এ কুলটা।
যখনই কোন আঘাত আসে বা আশা ভংগ হয় তখনই অন্যসব কুলের কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলায় দেখা বা শোনা সব কুলের কথা মনে পড়ে। আফসোচে ভরে ওঠে মনটা। আশা ভঙ্গ হলেই মনে হয় চলার নদীটা অপ্রশস্ত থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।
অপ্রশস্ত নদী ছেড়ে এসে অনেক কুলের মধ্যে একুলটায় বেছে নেয়ার ঘুটনা কি নিচক স্রোতের টান! ভাবে ইচ্ছা করলেই কি অপ্রশস্ত নদীতে ওর নৌকাটা থামিয়ে রাখতে পারতো।